প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ না করায় পদত্যাগ করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা। দেশের ইতিহাসে এ নিয়ে সাতবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা ঘটল। তবে সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করতেই হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’
আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগে বিচার বিভাগে কোনো প্রভাব পড়বে না। সরকার শিগগিরই আপিল বিভাগে আরও বিচারপতি নিয়োগ করে শূন্যতা পূরণের উদ্যোগ নেবে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সংবিধান অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। এ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে শিগগিরই আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ করা হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধানে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে- এমন কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি যাকে যোগ্য মনে করেছেন তাকেই নিয়োগে দিয়েছেন। তবে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগের বিষয়টি দুঃখজনক। অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, এটি নতুন কিছু নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ব্যক্তিগত কারণে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা পদত্যাগ করেছেন। এতে বিচার বিভাগের কোনো সংকট হবে না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, দেরিতে হলেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন নতুন কিছু নয়। গত ১৫ বছরে সাতবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বিএনপি সরকারের আমলে দুইবার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে চারবার এ ঘটনা ঘটেছে।
গত ১০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তবে এর আগে ৩৯ দিন তিনি ছুটিতে ছিলেন। তিনি ছুটিতে থাকাকালে গত ৩ অক্টোবর থেকে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গতকাল বিকেলে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রথম আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. রুহুল আমিনকে ডিঙ্গিয়ে ২০০৩ সালের ২৩ জুন বিচারপতি কে এম হাসানকে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় দফা বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেনকে ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১ মার্চ বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ পর্যন্ত চারবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারপতি এম এ মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে। পরে ওই দুই বিচারপতি মেয়াদ থাকা অবস্থায় আর বিচারকাজে অংশ নেননি। এরপর ২০১১ সালের ১২ মে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে দ্বিতীয় দফা জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার হন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। পরে তিনি ৭ মাসের বেশি সময় ছুটিতে থাকার পর ২০১১ সালের ১২ মে পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ গতকাল নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের মধ্যে দিয়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটল। এবার তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করেছেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা। সমকাল