জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারান্তরীণ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাইকোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন আদেশ স্থগিতের বিষয়ে সব বিচারপতি একমত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগ।
আজ সোমবার (১৯ মার্চ) সকালে এ জামিনের স্থগিতাদেশ দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘এটি আমাদের সবার ডিসিশন (সব বিচারপতির সিদ্ধান্ত)।’
এর আগে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) গ্রহণ করেন আদালত। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা (আপিল বিভাগের চার বিচারপতি) সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশ দিচ্ছি। লিভ, স্টে, ফোর উইকস, অ্যাপিলেন্ট কনসাইজ স্টেটমেন্ট দেবে। নেক্সটস উইক কনসাইজ স্টেটমেন্ট। নেক্সটস হেয়ারিং ২২ মে।’
এর পর আদালত থেকে আইনজীবী-সাংবাদিকসহ অনেকেই বের হয়ে যান।
এ আদেশের পর আপিল বিভাগ তার নিয়মিত কার্যক্রম অনুসারে অন্য মামলার শুনানি শুরু করেন। কিছু পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড, আমি দুঃখিত। আপনি কী আদেশ দিয়েছেন, সেটা বুঝতে পারিনি।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মত হয়ে এ আদেশ দিয়েছি।’
জয়নুল আবেদীন ফের বলেন, “আমি ‘সর্বসম্মত’ এটা জানতে চাইনি। কোন যুক্তিতে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করেছেন, সেটা জানতে চাই?”
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা নথি পর্যালোচনা করেছি।’
তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা তো মেরিটে (মামলার মূল বিষয়বস্তুতে শুনানি করিনি) বলিনি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপিলে বলতে পারবেন।’
এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপনারা সর্বোচ্চ আদালত। আপনারা যে আদেশ দেবেন শিরোধার্য। তবে ২২ মে অনেক দূর। আজকে যেভাবে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করলেন, এটা নজিরবিহীন। অতীতে এ জাতীয় ক্ষেত্রে কোনোদিন লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে তো সবই (অতীতের সব মামলায়) লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা উচিত ছিল।’
তখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে চার সপ্তাহের জায়গায় দুই সপ্তাহ করে দিতে নির্দেশ দেন।
এ পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি দুই সপ্তাহ করলেন। ২২ মে তারিখের ওই সময়টা এগিয়ে আনার অনুরোধ করছি।’
এ সময় ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন আদালতে বলেন, ‘সরকার যে উদ্দেশ্যে এটা করেছে…। দুদক আর সরকার তো একাকার হয়ে গেছে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়।’
এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সময়টা কমিয়ে দেন। এপ্রিলে করে দেন।’
তখন বিচারপতি ইমান আলী বলেন, ‘তখন তো ভ্যাকেশন (সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি)।’
ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, ‘ভ্যাকেশনের আগে দেন।’
বিচারপতি ইমান আলী বলেন, ‘আফটার ভ্যাকেশন।’
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আফটার ভ্যাকেশন হলে দিন নির্ধারণ না করলে তো একই থাকল?’
তখন প্রধান বিচারপতি ৮ মে পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত থাকার পাশাপাশি ওই দিন আপিল শুনানির দিন নির্ধারণ করেন। এ ছাড়া ওই দিন কার্যতালিকায় জামিন স্থগিতের বিষয়ে শুনানি অগ্রাধিকারে থাকবে।
রায়ের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ রায়ে তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এটি নজিরবিহীন রায়। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে।
এর আগে আদালতের এজলাসে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে বসেন। এরপর ২ নম্বর তালিকায় থাকা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বনাম খালেদা জিয়া, ৩ নম্বর আইটেমে থাকা রাষ্ট্র বনাম খালেদা জিয়ার মামলাটির আদেশ ঘোষণা করা হয়।
এর আগে গতকাল রোববার জামিন স্থগিতের বিষয়ের শুনানি শেষ করে আপিল বিভাগ আজ এ বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য রেখেছিল।
গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন স্থগিত চেয়ে পরের দিন রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক আবেদন করে। পরে ১৪ মার্চ আপিল বিভাগ গতকাল রোববার পর্যন্ত জামিনের স্থগিতাদেশ দেন। পরদিন ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জামিনের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করেন।
জামিনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য ওই দিন বিকেলেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা চেম্বার আদালতে আবেদন করেন। কিন্তু চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ওই আবেদনের শুনানিও আপিল বিভাগে করা হবে মর্মে আদেশ দেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং আসামিদের দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। রায় ঘোষণার পর পুরান ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারকে বিশেষ কারাগার ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়াকে সেখানে রাখা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক।
২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন-আর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান