ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
২০১৩ সালের ১৫ জুলাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘অপরাধের বাতিঘর’ হিসেবে চিহ্নিত রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের মামলার রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত হয়। এই মামলার রায়ের ৩৭৪ অনুচ্ছেদে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বলেছেন- ‘In the interest of establishing a democratic as well as non-communal Bangladesh, we observe that no such anti-liberation people should be allowed to sit in the helm of executives of the government, social or political parties including government and non-government organizations.’ পর্যবেক্ষণটির বাংলা ভাবার্থ দাঁড়ায়-গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো ব্যক্তিকে সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কোনো পদে বা দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া যাবে না।
মাননীয় ট্রাইব্যুনালের এই পর্যবেক্ষণটি নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে যখনই কোনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন তারা সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননা করেছেন, দেশ-বিদ্বেষী প্রজন্ম সৃষ্টি করেছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সুতরাং মাননীয় ট্রাইব্যুনালের এই পর্যবেক্ষণটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা বলেই বিবেচ্য।
২০১৩ সালের জুলাই মাস হতে আজ আমরা ২০১৮-তে উপনীত। প্রায় ৫ বছর হতে চলেছে। কিন্তু মাননীয় ট্রাইব্যুনালের এই গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শনাটি সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে আমরা দেখিনি। অথচ এই সত্যটি আমরা সকলেই অনুধাবন করি যে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কোনো ঠাঁই নেই। তারপরও আমাদের সব অভিব্যক্তি শুধু টেলি-চ্যানেলের মধ্যরাতের তর্ক-বিতর্ক, পত্র-পত্রিকায় কালে-ভদ্রে কলাম-লেখনী আর কিছু সভা-সেমিনার বা মানববন্ধনে সীমাবদ্ধ থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বর্জন করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোন সার্কুলার জারি করা হয়নি, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নীতি-নির্ধারণী রেজ্যুলেশন প্রণয়ন করা হয়নি, কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেনি, এমনকি দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো কোনো নৈতিক অবস্থান জারি করেনি।
তবে হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গঠনতন্ত্র উপ-কমিটির সভায় তিনটি আশাবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এগুলো হলো: ১. যুদ্ধাপরাধী পরিবারের কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যও হতে পারবে না; ২. বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত পরিবারের কোনো ব্যক্তিও আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবে না; এবং ৩. আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় সম্মেলনে দলটির গঠনতন্ত্রে ওপরে বর্ণিত দুটি নিষেধাজ্ঞা সংযোজনের প্রস্তাব করা হবে।
আওয়ামী লীগের এই ধরনের সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান দেশবাসীর সামনে ঘোষণা করার জন্য তারা সাধুবাদ পেলেও খুব হতাশ হই যখন দেখি আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী ও সুবিধালোভী নেতাকর্মী ফুল হাতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বরণ করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী লীগকে যখন এভাবে নৈতিকতার সঙ্গে আপোস করতে দেখি তখন খুব কষ্ট হয়, বুকটা মুচরে ওঠে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নিরলস আত্মোৎসর্গের কথা মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কালিমার ছাপ দেখতে পাই। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের এই বলিষ্ঠ ও দৃঢ় অবস্থান আমাকে আবারো আশাবাদী করে তোলে-লাল সবুজের পতাকাটি যেন শকুনিদের নখর থেকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়।
এখন প্রত্যাশা দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। তাদেরও উচিত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির ব্যাপারে তাদের অবস্থান দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার করে তোলা। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা দুটো কখনই একসঙ্গে যেতে পারে না। এই দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি নৈতিক দায়িত্ব হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। সুতরাং যারাই এই লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গিয়ে ভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করবে তাদের এই দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকবে না। অন্তত সাধারণ জনগণ তা যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘অপরাধের বাতিঘর’ হিসেবে চিহ্নিত রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল আরো বলেছিলেন : ‘We are of the opinion that the government may take necessary steps to that end for debarring those anti-liberation persons from holding the said superior posts in order to establish a democratic and non-communal country for which millions of people sacrificed their lives during the war of liberation.’ অর্থাৎ পর্যবেক্ষণে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, যে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই রাষ্ট্রের সরকারের উচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির কোনো ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা। মাননীয় ট্রাইব্যুনালের এই ধরনের পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি যেন রাষ্ট্রের কোনো পদে বা দায়িত্বে নিয়োগ না পায় সে ব্যাপারে সদাসতর্ক থাকা।
বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যে কঠিন পরীক্ষা উত্তীর্ণ করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে করা সক্ষম। এই ব্যাপারে কোনো রকম চাপ, দেশি বা বিদেশি, তারা আমলে নেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের বিচার ব্যবস্থা এক সময়ের রূঢ় সমালোচনাকারীদেরও অভিভূত করেছে-তারা নিজেরাও এখন ভূয়সী প্রশংসা করেন আমাদের বিচার ব্যবস্থার।
মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দলটি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা চাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকারও যেন এমন কঠোর অবস্থান নেয়। যুদ্ধাপরাধী পরিবারগুলোর সদস্যরা যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো পদে বা দায়িত্বে আসীন না হতে পারে তার জন্য সরকার যেন সদাসতর্ক থাকে। আর শুধু সতর্ক থাকলেই হবে না, একই সঙ্গে আইন করে তাদের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করতে হবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে বর্জন করেছেন, ঠিক তেমনিভাবেই সরকারপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় সব পর্যায় হতে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে নির্মূল করবেন।
লেখক- প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল।