দীর্ঘ দুই বছরেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুরু হয়নি ২৩ মানবতাবিরোধীর আপিল শুনানি। জনগুরুত্বপূর্ণ এসব মামলার শুনানি না হওয়াকে ভুক্তভোগী শহীদ পরিবার ও বিচার প্রার্থীদের কাছে হতাশার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আপিল বিভাগে সর্বশেষ জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর আপিলের ওপর শুনানি হয়। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এ শুনানি শেষ হয়। এরপর একই বছরের ৮ মার্চ আপিলের রায়ে এই শীর্ষ অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে আলবদর নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এদিকে দীর্ঘ দুই বছরে কোনও শুনানি না হওয়ায় আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে। যা ভুক্তভোগী শহীদ পরিবার ও বিচার প্রার্থীদের কাছে হতাশাজনক বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ।
প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা প্রসিকিউশনে যখন কাজ করেছি, তখন নানান প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে, কষ্ট করে মামলার শুনানি শেষ করেছি। এরপর রায় শেষে তা দ্রুত আপিলে শুনানির সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। কিন্তু ২০১৬ সালের পর এখনও আপিলের শুনানি না হওয়ার বিষয়টি একজন প্রসিকিউটর হিসেবে আমাকে ব্যথিত করে। কারণ, আপিল শুনানি দেরি হলে প্রাকৃতিকভাবেই এসব অপরাধী মারা যাবেন। এর ফলে কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে না। তারা অপরাধী নাকি অপরাধী নন, তাও চূড়ান্তভাবে অপ্রমাণিত থেকে যাবে।’
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত রায় ঘোষিত হয়েছে ৩২টি মামলার। তবে এখনও বিচারাধীন রয়েছে ২৩টি মামলা। ট্রাইব্যুনালের রায় হওয়া ৩২টি মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল ৭২ জন। এরমধ্যে ৯টি মামলার আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ৬ জনের। আর সর্বোচ্চ আদালতে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে ২৩টি আপিল।
আপিলে শুনানির অপেক্ষায় থাকা ২৩টি মামলার মধ্যে রয়েছে—জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও মো. ওবায়দুল হক তাহের, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মুহিবুর রহমান বড় মিয়া এবং তার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া এবং তাদের চাচাতো ভাই আবদুর রাজ্জাক, যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সাখাওয়াত হোসেন, যশোরের বিল্লাল হোসেন, কিশোরগঞ্জের মো. মোসলেম প্রধান, ময়মনসিংহের আব্দুল লতিফ, মৌলভীবাজারের উজের আহমেদ ও ইউনুস আহমেদ, আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম হোসেন, কিশোরগঞ্জের সামসুদ্দিন আহমেদ, জামালপুরের এসএম ইউসুফ আলী (বর্তমানে মৃত), ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সামসুল হক বাচ্চুর আপিল। এছাড়া, জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ড বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আবেদন জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা একটি আপিলও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রসিকিউটর জেয়াদ আর মালুম বলেন, ‘সীমাহীন কষ্ট ও হুমকি সহ্য করে আমাদের এসব মামলা পরিচালনা করতে হয়েছে। যতটা পেরেছি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আমরা এসব মামলার শুনানি শেষ করেছি। ভুক্তভোগী শহীদ পরিবারের সদস্যরা দ্রুত আপিল নিষ্পত্তি চান। সেক্ষেত্রে তাদের অনেকেরই ধারণা—এটি দীর্ঘসূত্রতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ভুক্তভোগী শহীদ পরিবার ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে চরম হতাশার জন্ম দিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই দিনে ট্রাইব্যুনালের জন্য নিজস্ব প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থাকে যুক্ত করা হয়। তিন বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ চলতে থাকে বিচারকার্য। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হয়। যা ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নিষ্ক্রিয় করে ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠিত হয়।
এদিকে, তদন্ত সংস্থার সূত্রমতে, তাদের হাতে আসা ৭২৮টি অভিযোগের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে ৫৯টি মামলার। আর তদন্তাধীন রয়েছে ৩০টি অভিযোগ।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক মো. সানাউল হক মনে করেন, তদন্ত সংস্থার হাতে যত অভিযোগ রয়েছে, তার নিষ্পত্তি করতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা একাধিক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি আপিলে থাকা মামলাগুলোর শুনানির জন্য একটি পৃথক আপিল বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে। এসব বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল উদ্যোগ নিতে পারেন।
প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ বলেন, ‘মামলাগুলো জাতীয়ভাবে সংবেদনশীল। এমনিতেই আমরা স্বাধীনতার বহু বছর পর এসব অপরাধীর বিচার শুরু করেছি। তাই এই আসামিদের আপিল দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে যদি আরেকটি পৃথক আপিল বেঞ্চ করা হয়, তাহলে মামলাজটের কারণে এসব মামলার শুনানি পিছিয়ে পড়বে না। তাছাড়া, আপিলের মামলা থাকার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালে আরও অনেক মামলার রায় হচ্ছে। সুতরাং তা শুনানির জন্য উদ্যোগী হওয়া ও আপিলের পৃথক বেঞ্চ করা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, অ্যাটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতের মামলাগুলো কার্যতালিকায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হবেন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আপিল নিষ্পত্তিতে পৃথক বেঞ্চ গঠনের কোনও প্রয়োজন নেই।
তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আপিল নিষ্পত্তির বিষয়ে জোর দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইনি কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলা তো শুনানির জন্য লিস্টে (কার্যতালিকায়) আছে। তবে আদালত (আপিল বিভাগ) অন্যান্য মামলা শুনছেন, এসব মামলাও শুনবেন।’
শুনানি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কোনও পরামর্শ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কয়েকটি আপিল (এটিএম আজহারুল ইসলাম, মাওলানা আবদুস সুবহান ও সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার) কিন্তু নিয়মিত আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এসেছে। তবে অন্য মামলা শুনতে গিয়ে তাদের আপিলগুলো শোনা হচ্ছে না। এ বিষয়ে আদালত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে মনে করি।’
তবে যেকোনও সময় আসামিদের আপিলের বিরুদ্ধে শুনানির জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বাংলা ট্রিবিউন