শায়লা জাহান
আমাদের দেশে দেওয়ানী আদালতগুলোতে স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত বাটোয়ারা মামলার সংখ্যা অনেক। বাটোয়ারা সম্পর্কিত কোন সংবিধিবদ্ধ আইন এখনও প্রণয়ন হয় নাই। এই ধরনের মামলা পরিচালনার জন্য অন্যান্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। উচ্চ আদালতের বিচারিক সিদ্ধান্তগুলো এই আইনের প্রধান উৎস। পার্টিশন অ্যাক্ট, ১৮৯৩ সালের আইনে পার্টিশনের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা উল্লেখ নাই। সাধারন অর্থে পার্টিশন হচ্ছে এজমালী সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর যাই হোক নিজ ধর্মের আইনানুসারে আপোষমূলে ভাগবণ্টন। Partition refers to re-distribution or adjustment of pre- existing rights among the coparceners where the portion of family members has become separate follows termination of joint liability and ownership. Separation of shares can only be possible among those having interest on it. পার্টিশনে কোন পক্ষের অসম্মতি থাকলে অন্য পক্ষ উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করার বিধান আছে। পূর্বসূরিদের মধ্যে যৌথ সম্পত্তির মালিকানা ও দখল নিয়ে ঐক্যমত থাকলেও পরবর্তীতে উত্তরসূরিদের মধ্যে মতানৈক্যর ভিত্তিতে বাটোয়ারা মামলার উদ্ভব হয়। সম্পত্তির বিলিবণ্টনের প্রশ্ন আসে যেখানে যৌথ মালিকানা, সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব, উক্ত সম্পত্তি থেকে আগত মুনাফা যা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। মৃত ব্যক্তির বৈধ ওয়ারিশ যারা আছেন তাদের মধ্যে মুসলিম ফারায়েজ আইন অনুযায়ী সম্পত্তি সরসে নিরসে বণ্টন হয়ে থাকে।
অনেক সময় দেখি যে, সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছুটা বৈষম্য হয়ে থাকে। একজন সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ বেশি থাকার কারনে তাকে হয়তবা বেশী অংশ দেয়া হয়। মুসলিম আইনের হেবা সম্পর্কিত বিধান এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। নিজ ওয়ারিশদের মধ্যে পছন্দমত যাকে ইচ্ছা তাকে হেবা করার স্বাধীনতা রয়েছে। সুতরাং এভাবে হেবা করে দিলে সেখানে বাটোয়ারার প্রশ্ন অবান্তর। তবে শর্ত হল যে, হেবা করার জন্য অপরিহার্য উপাদানগুলোর উপস্থিতি থাকতে হবে। ১৮৮২ সালের ১২৩ ধারার বক্তব্য হল স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে হেবাতে দুইজন সাক্ষীসহ দলিল দাতার ও গ্রহীতার স্বাক্ষর সাব রেজিস্টার দ্বারা সম্পাদিত দলিল বৈধ হবে।
কোন মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে উত্তরাধীকার নীতি অনুযায়ী তার অবর্তমানে স্ত্রী সন্তানরা বৈধ ওয়ারিশ হিসেবে সম্পত্তির মালিক হবেন। আমাদের সমাজে এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে সম্পত্তির ওয়ারিশ হিসেবে কন্যা বিবাহিত হলে পুত্র ওয়ারিশরা সম্পত্তির ভাগ দিতে অনিহা করে থাকে। মুসলিম ব্যক্তিগত (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭ এ বলা আছে যে কন্যা হচ্ছে জবিউল ফুরুজ অর্থাৎ অংশীদার যেখানে তিন শ্রেণীর উত্তরাধীকারীদের মধ্যে অংশীদার (sharer) এর স্থান প্রথম শ্রেণীতে যে কারো দ্বারা বাদ যাবে না। যদিও ভ্রাতার অংশের অর্ধেক পাবে কিন্তু সেই অংশের উপর পূর্ণ অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। সুতরাং এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যেখানে আপোষমূলে ভাগবণ্টন সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে পিতার সম্পত্তির বৈধ ওয়ারিশ হিসেবে বোন পার্টিশন স্যুট দায়ের করতে পারবে।
বাটোয়ারা মামলা করার পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে যে সম্পত্তি আগে উইল বা হেবা করা হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তাহলে উইলের ক্ষেত্রে ১/৩ অংশ বাদ দিয়ে কিংবা হেবা করা হলে হেবার দলিলে যে পরিমাণ মালিকানা আছে সেটা বাদ দিয়ে অন্য সহ শরীকের অংশ বের করতে হবে। মামলা রুজুর আগেই অন্য শরীকানদের নোটিশ দিতে হবে। কোন শরীকান যদি তার অংশ বিক্রি করতে চায় অবশ্যই তাকে অন্য শরীকানদের কাছে তার অংশটি কেনার জন্য প্রস্তাব দিতে হবে অন্যথায় প্রিয়েমশন মামলার কারন উদ্ভব হয়। এই ধরনের মামলায় পূর্বসূরীর মৃত্যু সনদ (যার মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তরিত হয়েছে), ওয়ারিশান সনদ, উক্ত সম্পত্তির মালিকানা দলিল, মালিকের record of rights দলিল সমুহ গুরুত্বপূর্ণ।
স্থাবর সম্পত্তি যা সহ-শরীকের দখলাধীন ও একচ্ছত্র অধিকারে রয়েছে যেখানে অন্য শরীকানরা ভিন্ন মতের পক্ষে হলে তখন প্রাপ্য হিস্যা অনুযায়ী উক্ত যৌথ সম্পত্তি বণ্টনের জন্য বাটোয়ারা মামলা আবশ্যক।
এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরলাম
যদি কোন যৌথ সম্পত্তির সুনির্দিষ্ট অংশে একজন সহ-মালিক একচ্ছত্র দখলকার হয়ে থাকে তবে অন্যান্য সহ অংশীদারগণ তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সম্পত্তি সরসে নিরসে বণ্টন করতে হবে। এটাই সাধারন নিয়ম কারণ সরস নিরস বণ্টন ব্যতীত কোন সহ অংশীদার সম্পত্তির কোন অংশের একচ্ছত্র দখলকার হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। (১৯৬০) ১২ ডি. এল. আর ৭০৮)
একজন সহ-শরীক কে এজমালি সম্পত্তির দখল থেকে বহিষ্কার করা যায় না। যদি উক্ত সম্পত্তিতে সহ-শরীক বেশী অংশের দখলে থাকে তাহলে তার সমাধান বাটোয়ারার মামলার মাধ্যমে করতে হবে। (৫ ডি. এল. আর, ১৯৫৩)
নালিশী সম্পত্তির যৌথ মালিকানার বিভাজন করতে হলে রেকর্ড অফ রাইটস এ বর্তমান মালিক এক বা একাধিক এর নামে থাকতে হবে। কেননা মামলা প্রমাণের জন্য এটি একটি অপরিহার্য দলিল। “As per sec 144A of SAT Act last record of rights is the evidence of title unless it is proved to be incorrect by a court of law in a properly framed suit. Reliance in this respect may be referred to a judicial pronouncement- the record of rights has presumption of correctness till it is rebutted”, 50 DLR 186, 8 BLD 497. বর্তমান রেকর্ড যদি বাদীর নাম বা তার পূর্বসূরীর নামে না থাকে কিংবা খতিয়ানে যেভাবে উল্লেখ আছে তা নালিশী সম্পত্তির সাথে না মিলে তবে বাদীর সত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। সুতরাং সত্ত্বের আবেদন না করে শুধু পার্টিশন মামলা করলে মামলা খারিজ হতে পারে। Ref- 17 BLD (AD) 179, 13 BLD 621, 23 BLD (AD) 68
পার্টিশন মামলায় বর্তমান রেকর্ডেড মালিককে অবশ্যই পক্ষ করতে হবে কেননা এই পক্ষভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্যথায় মামলা খারিজ হবে। (40 DLR 532, 37 DLR (AD) 216) তাছাড়া রেকর্ডেড মালিকের পক্ষভুক্তি ছাড়াই যদি মামলার বাদী ডিক্রী প্রাপ্ত হন এবং সেই ডিক্রী রদ করার জন্য রেকর্ডেড মালিক আবেদন করলে উক্ত ডিক্রী বাতিল হবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট