সদ্য সমাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত সমর্থিত আইনজীবীদের জয়জয়কার। অপরদিকে ভরাডুবি হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের। প্রায় দশ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দলীয় নেতৃত্ব হারিয়েছে বহুবার। আর বেশকয়েক বছর যাবত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এবারও বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের বিশাল জয়ের কারণ অনুসন্ধান করেছে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। অনুসন্ধানে আইনজীবী নেতা ও সাধারণ আইনজীবীদের মতামত জানার চেষ্টা করা হয়।
মূলত, আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের স্বজনপ্রীতি, যোগ্যতর প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যর্থতা, সাধারণ আইনজীবীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ না রাখা, জুনিয়র আইনজীবীদের সাথে ব্যবহারের মাত্রা ঠিক না রাখা, সমন্বয়হীনতার অভাব, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগ, দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতের বিষয়সহ নানা কারণ বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের জয়কে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
কুষ্টিয়া আদালতে প্র্যাকটিসরত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি মনে করেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেলে শৃঙ্খলা ছিলনা। যেমন, কুষ্টিয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদক আওয়ামী সমর্থিত হওয়া সত্ত্বেও দলীয় সমর্থকদের এক প্রকার না জানিয়েই ঢাকা চলে গেছেন। অপরদিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতারা সাধারণ আইনজীবীদের ঢাকায় নিতে এসি গাড়ীসহ ঢাকায় থাকা-খাওয়ার সু-ব্যবস্থা করেছেন। সিরাজ প্রামাণিক আরও বলেন, ভোট দিতে গিয়ে দেখি সাদা প্যানেলের সিনিয়র নেতারা ভোটারের সাথে সৌজন্যতাস্বরূপ কুশল বিনিময়ের পরিবর্তে কতিপয় চাটুকরদের সাথে সেলফি তোলায় মগ্ন! এই আইনজীবী বলেন, এসব কারণে সাদা প্যানেলের ভোট কমেছে, আর অপরদিকে বিএনপি সমর্থিরা জয়ী হয়েছে খুব সহজে।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন মন্তব্য করেছেন, অবশ্যই সব আওয়ামী ভোটাদের ভোট কেন্দ্রে আনা যায় নাই। প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের ভোট সংগ্রহের তফাৎ তার প্রমাণ। এছাড়া দলীয় কোন্দল দূর করতে না পারলে ভবিষ্যতেও একই অবস্থা হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মোঃ মনিরুজ্জামান সোহান মনে করেন, আওয়ামী আইনজীবীদের ঐক্যের অভাব আর অভ্যন্তরীন ষড়যন্ত্র বিএনপিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী আইনজীবীদের অহেতুক ক্ষমতার গরম দেখানো, শো ডাউন দিয়ে মনোনয়ন ফর্ম কেনা, কিছু সিনিয়র আইনজীবীর অহংকারী ভাব নিয়ে চলাফেরাসহ আরো অনেক ইস্যুই পরাজয়ের কারণ। অনেকেই বলেছেন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতের প্রতিবাদ হিসেবে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের জয়যুক্ত করেছেন সাধারণ আইনজীবীরা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিদের ভুল ছাড়াও বিএনপি-জামাতও নির্বাচনে জয়ী হতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে বলে মন্তব্য করেন বেশ কিছু আইনজীবী। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বারবার জয়ী হওয়া প্রার্থীর ওপর ভরসা রাখা এবং নির্বাচনের আগেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্যানেলকে ঐক্যবদ্ধ করা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মহিউদ্দিন হক চৌধুরী নীল প্যানালের প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ইমেজ, পারসোনাল ভোট, আন্তরিকতা ও নির্বাচনের আগে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্যানেলকে ঐক্যবদ্ধ করা বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের বিজয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আইনজীবী জাহেদুল ইসলাম ইমনও প্রায় একই মত দিয়ে বলেছেন, বিএনপি-জামাত সমর্থিত প্যানেলের একতা। যারা নমিনেশন পায়নি তারাও দলের জন্য এক হয়ে কাজ করেছে। কোনো বিদ্রোহ ছিলোনা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জয় এসেছে।
অ্যাডভোকেট রাশেদ নেওয়াজ মনে করেন, বাংলাদেশের বড় ৩টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২টি বিএনপি (জামাতসহ) ঘরনার। ওনাদের যৌথ ভোট ব্যাংক জয়ের অন্যতম কারণ।
আইনজীবী আলাউদ্দিন ভূঁইয়া বিএনপি’র ভোটার বাড়ানোর কৌশল উল্লেখ করে বলেন, বিএনপি-জামাত যখন বার কাউন্সিলের নেতৃত্বে ছিল তখন জামায়াত বিএনপি সমর্থিত প্রচুর আইনজীবীকে হাইকোর্টের সনদ দেয়া হয়েছিল৷তখন কোন বিধিই কাজ করে নাই৷আমার পরিচিত অনুরুপ কয়েকজন আছে যারা এভাবে সনদ নিয়েছিল৷
প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে সভাপতি, সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সহ-সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদক এবং সদস্য পদে ১০ জন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে ১ সহ সম্পাদকসহ ৩ সদস্য পদে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। এর আগের বছর আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা জিতেছিলেন ছয়টি পদে, আর বিএনপিপন্থীরা জিতেছিলেন আটটি পদে।