সরকারি জিম্মা থেকে অর্পিত সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে । অর্থাৎ স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থা অর্পিত সম্পত্তি কিনে সেখানে বাড়িঘর করতে পারবে। শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এসবও করা যাবে। সরকারি কর্মচারীরাও জোট বেঁধে এই সম্পত্তি কিনতে পারবেন। এসব বিধান রেখে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এক কর্মকর্তা বলেন, অর্পিত সম্পত্তির বোঝা আর বইতে চাইছে না সরকার। অর্পিত সম্পত্তি আসলে সরকারের সম্পত্তি নয়। সরকার এসব সম্পত্তির জিম্মাদার মাত্র। সরকার চায়, যারা এসব সম্পত্তির মালিক তারা তাদের সম্পত্তি বুঝে নিক। এরপরও যেসব সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকবে সেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বার্থকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। এরপরও যেসব সম্পত্তি থাকবে সেগুলো স্থায়ী ইজারার নামে বিক্রি করে দেওয়া হবে।
বর্তমানে সরকারের দখলে থাকা অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ হচ্ছে দুই লাখ ২০ হাজার একর। এসব সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে আদালতে এক লাখ ১৯ হাজার মামলা চলছে।
ভূমিসচিব মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমরা বিধিমালার খসড়া করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে ফিরে এলে বিধিমালা প্রকাশ করা হবে।’
গত শতকের ষাটের দশকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যারা সহায়-সম্পদ ফেলে জীবন নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল, তাদের সম্পত্তিকে তখনকার পাকিস্তান সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করেছিল। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তা অর্পিত সম্পত্তি নাম পায়। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এসব সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা চললেও এর কোনো নীতিমালা ছিল না। এই প্রথম নীতিমালা করা হচ্ছে। কিন্তু নীতিমালার বিভিন্ন অংশ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। গত ১ মার্চ তিনি বলেন, ‘যে উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল তার বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওই সম্পত্তি প্রাপ্তির বিধি প্রণয়ন নতুন করে সম্পত্তি আত্মসাতের ষড়যন্ত্র। এই খসড়া বিধিমালা বাতিল করা না হলে আমরা আবারও আন্দোলনে যাব। কারণ খসড়া বিধিমালায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্পিত সম্পত্তি স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমবায় সমিতি করে অর্পিত সম্পত্তিতে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। খসড়া এই বিধি ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকার পরিপন্থী।’
এক প্রশ্নের জবাবে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সরকার এখনো বিধিমালাটি প্রকাশ করেনি। তবে আমরা খসড়া বিধিমালার বিভিন্ন অসংগতির কথা জেনেছি।’ সরকারি কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছাড়াও আরো বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় থাকতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, কমপক্ষে ১৫ বছর যাঁরা সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে রয়েছেন এ ধরনের কমপক্ষে ১০ জন কর্মচারী সমবায় সংগঠন গড়ে নিজেদের আবাসিক প্রয়োজনে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য অর্পিত সম্পত্তি স্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে পারবেন। তাঁরা মেট্রোপলিটন বা সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চ ৬৬ শতাংশ এবং জেলা ও থানা পর্যায়ে সর্বোচ্চ এক একর অকৃষি অর্পিত সম্পত্তি বন্দোবস্ত পাবেন। জনপ্রতি সর্বোচ্চ হার হবে মেট্রোপলিটন ও সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ এবং জেলা ও থানা সদরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আট শতাংশ।
খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, কারখানা বা বাড়ির কাছে অর্পিত সম্পত্তি থাকলে ওই বাড়ি বা কারখানার মালিককে অর্পিত সম্পত্তি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। এই সম্পত্তি কৃষি বা অকৃষি যাই হোক না কেন তা নির্ধারিত বাজারমূল্যে সংশ্লিষ্টদের কাছে বিক্রি করা যাবে। বাজারমূল্য নির্ধারণের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সভাপতি করে সাত সদস্যের জেলা কমিটি গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার এসি ল্যান্ড ওই কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে থাকবেন গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার, বন বিভাগ ও ভূমিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রারের অফিস থেকে প্রস্তাবিত একই ধরনের জমি কেনা-বেচার তথ্য সংগ্রহ করে গড় বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হবে। সম্পত্তির যে দাম আসবে সংশ্লিষ্টরা তা বার্ষিক ৫ শতাংশ সুদসহ তিনটি সমান কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তির টাকা ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। পুরো টাকা ১৮ মাসের মধ্যে পরিশোধ না করলে বন্দোবস্ত বাতিল করা হবে। দেশের যেকোনো শহরাঞ্চলে জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে এমন কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন আবাসিক প্রয়োজনে শহরাঞ্চলে কোনো ধরনের অকৃষি সরকারি সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি বন্দোবস্ত পাবেন না।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, সরকার ব্যবহার করছে বা সরকারের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ সম্পত্তি সংরক্ষণ করে অবশিষ্ট সব সরকারি সম্পত্তি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। যত দিন স্থায়ী বন্দোবস্ত না দেওয়া হবে তত দিন একসনা বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। অর্পিত সম্পত্তি বন্দোবস্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে একই হোল্ডিং বা খতিয়ানের সহ-অংশীদারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সহ-অংশীদার না থাকলে যিনি সরকারি পাওনা পরিশোধের মাধ্যমে ভোগদখল করছেন তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। এসব অগ্রাধিকারপ্রাপ্তরা সম্পত্তির নির্ধারিত বাজারমূল্যের ১০ শতাংশ কম মূল্যে অর্পিত সম্পত্তি কিনতে পারবেন। যেকোনো সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে অর্পিত সম্পত্তি বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য অকৃষি জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, এতিমখানা, আশ্রম, কবরস্থান, শ্মশানঘাট স্থাপনের জন্য স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত বাজারমূল্যের ১০ শতাংশ দাম দিতে হবে।
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে নিজ অবদানের জন্য বিশেষভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিকে আবাসিক প্রয়োজনে মেট্রোপলিটন বা সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ এবং মেট্রোপলিটন ও সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ অকৃষি সরকারি সম্পত্তি নির্ধারিত বাজারদরে স্থায়ী ইজারা দেওয়া যাবে। শহর এলাকার বাইরে শিল্প স্থাপনের জন্য আবেদনকারী যদি ন্যূনতম প্রয়োজনের তিন-চতুর্থাংশ নিজে সংগ্রহ করে থাকেন তাহলে ওই জমিসংলগ্ন অর্পিত সম্পত্তি থাকলে তাঁর কাছে তা বিক্রি করা যাবে। যেসব অর্পিত সম্পত্তি সরকারের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হবে তা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে থাকবে না। এসব সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ১/ক নম্বর খতিয়ানভুক্ত করা হবে। অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করতে হলে তা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের অনুমতি নিতে হবে।
এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের সব সার্কুলার, স্মারক, নির্দেশনা বাতিল হবে। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি ছাড়া দেশের অন্য সব জেলার জন্য এ বিধিমালা প্রযোজ্য হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এই বিধিমালা পরিবর্তনের এখতিয়ার সরকারের হাতে রাখা হয়েছে। সূত্র: কালেরকন্ঠ