তথ্য-প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ বেশ কয়েকটি ধারা বাতিলের প্রস্তাব করে বহুল আলোচিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ গতকাল সংসদে উঠেছে। প্রস্তাবিত আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। সোমবার সংসদের বৈঠকে বিলটি উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। পরে বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চার সপ্তাহের সময় দিয়ে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
বিলটি উত্থাপনে আপত্তি তুলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, বিলের ৩২ ধারার কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুরোপুরি হুমকির মুখে পড়বে। এটি একটি বৈরী আইন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে মৌলিক অধিকারবঞ্চিত দেশ গড়ার দিকে যাওয়া হচ্ছে। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার ও জামিন অযোগ্য বিধানগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। তিনি আরও বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওয়াদা করেছিলেন, ৩২ ধারার একটি উপ-ধারা সংযুক্ত করা হবে। একটি সেইফটি ক্লজ রাখা হবে। কিন্তু উত্থাপিত বিলে তা রাখা হয়নি।’
জবাবে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিলটি উত্থাপন করতে না দিলে প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা করার সুযোগ কীভাবে হবে। সংসদীয় কমিটিতে এসব বিষয় যুক্ত করা হবে।
এর আগে বিকেল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারায় সন্নিবেশ করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকেই গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্নিষ্ট মহলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি : প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কেউ এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য। এই ধারাটি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের আপত্তি রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা :২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচার চালান বা তাতে মদদ দেন তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের কারণে ওই ব্যক্তির ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ এই অপরাধ বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত : বিলে ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছায় ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ হবে অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয় বা বারবার করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হবে।
মানহানিকর তথ্য প্রকাশ : বিলের ২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি-সংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। আর ওই অপরাধ দ্বিতীয় বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এই ধারার অপরাধ অ-আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে আপসযোগ্য হবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট : ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে একটি অপরাধ। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর একই অপরাধ যদি দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হবে।
রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা : রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা বা জনগণের কোনো অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে কেউ কোনো কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে বৈধ প্রবেশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে বা বেআইনি প্রবেশ করলে বা তাতে সহযোগিতা করলে তিনি সাইবার সন্ত্রাসের অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন। সে জন্য তার ১৪ বছরের কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগ : বিলের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ বাংলাদেশের বাইরে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, যা বাংলাদেশে সংঘটন করলে এই আইনের অধীনে দণ্ডযোগ্য হতো তাহলে এই আইনের বিধানাবলি একইভাবে প্রযোজ্য হবে যেন, ওই অপরাধ তিনি বাংলাদেশেই সংঘটন করেছেন।
যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাহায্যে বাংলাদেশের ভেতর এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের বিধান এমনভাবে প্রযোজ্য হবে যেন এই অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশেই সংঘটিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা : প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে সংঘটিত কোনো অপরাধ তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন হলে অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইন-২০১২-এর বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে।
ব্যাংক-বীমা : প্রস্তাবিত আইনের ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ব্যাংক, বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধভাবে বা আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া ‘ই-ট্রানজেকশন’ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ অপরাধ হবে।
৫৭ ধারার বিচারাধীন মামলা চলবে : প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে। তবে এ ধারাগুলোতে কোনো মামলা বিচারাধীন থাকলে তা এমনভাবে চলবে যেন এই ধারাগুলো বিলুপ্ত হয়নি।
বিলটি আনার উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী লিখিত বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১ :ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ও নিরাপদ ব্যবহার আবশ্যক। বর্তমান বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফল ভোগের পাশাপাশি অপপ্রয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে সাইবার অপরাধের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।