আমীর-উল ইসলাম
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ তিনটি ঘটনা একসূত্রে গাঁথা। এ বিষয়ে বলতে গেলে পূর্বাপর আরও কিছু ঘটনা না বললে বিষয়টি পরিষ্কার হবে না।
২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট সংঘটিত হওয়ার সময় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে তার আগমুহূর্তে ২৫ মার্চ দিনগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) একটি ছোট ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।
এদিকে ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যার সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ নিজ বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে যান। এ সময়েই তিনি বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিকল্পনা শুরু করেন। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সবশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন তিনি।
এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। সঙ্গে ছিলাম আমি। ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাই আমরা। সীমান্ত অতিক্রম করার আগে তৎকালীন মেহেরপুরের মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-এলাহীকে দিয়ে ভারতীয় বাহিনীতে খবর পাঠানো হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের দুইজন নেতা ভারতে প্রবেশের অনুমতি চাইছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এর অনুমতি দেয় এবং সার্বিক সহায়তা দেয়।
সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় অভ্যর্থনা জানায় আমাদের। তখনকার বিএসএফ’র মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার আমাদের সম্মান জানিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। গোলক মজুমদারের কাছে খবর পেয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কে এফ রুস্তমজী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। তাজউদ্দিন আহমেদ তাকে বাংলার সার্বিক পরিস্থিতি এবং বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে জানান।
এ সময় রুস্তমজী দিল্লিতে সরাসরি যোগাযোগ করলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়, তাজউদ্দীন আহমেদ ও আমাকে নিয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার জন্য। সেখানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করবেন।
আমরা ২ এপ্রিল বিমানে করে দিল্লি যাই। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন।
এ সময় তাজউদ্দিন আহমেদ উপলব্ধী করেন, আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না। সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ওই সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কি না।
তখন তিনি (তাজউদ্দিন আহমেদ) সিদ্ধান্ত নেন, বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরবেন। কারণ তাতে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়ছিল তা কার্যকর হতে পারে বলে তাজউদ্দীনের ধারণা হয়।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন জানান, পাকিস্তানি আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সব প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য।
মুজিবের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতাকর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করে দিল্লির ওই সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেন। ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা।
বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ১০ এপ্রিলের ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে স্বদেশ ভূমি থেকে বিতাড়িত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য প্রথম সরকার গঠন করা হয়।
১০ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির জন্য দু’টি ঐতিহাসিক দিন। কারণ ১০ এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠনের পর ১৭ তারিখে প্রথম সরকার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (পরে মুজিবনগর নাম হয়) আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।
পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে শুরু হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সংগঠন ও সমন্বয়ে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে এবং সর্বোপরি এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী দেশ ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধতা যুদ্ধের রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বাস্তব রূপ নেয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১১ এপ্রিল রাতে আগরতলা সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। সেখানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ছাড়াও কর্নেল ওসমানী ছিলেন। যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লি, কলকাতাসহ দেশের ভেতরে-বাইরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়। সেখানে যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা হয়। সেখানে আমি সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলাপ করি। কারণ, ব্যক্তিপর্যায়ে আলোচনা হয় ব্যক্তির সঙ্গে। কোনো দেশের সঙ্গে কথা বলতে হলে দেশের প্রতিনিধি লাগে।
এর আগে অবশ্য ১০ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দেন। যা রেডিওতে প্রচারিত হয়। ওই সময়েই প্রবাসী সরকারের করণীয় ও কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়। ঠিক হয়, প্রথমে অত্যাচারিত মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এই লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন সীমান্তপথে বাংলাদেশিদের সীমান্ত পার হয়ে নির্বিঘ্নে চলে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার জন্য দু’টি প্রবেশপথ ঠিক করা হয়। একটি আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজন কলকাতা দিয়ে ঢুকবে। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তুরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভূরুঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকির মতো ছোট ছোট কিছু প্রবেশপথ ঠিক করা হয়।
কিন্তু তখনো মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেনি। তাই ১৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়। শপথের জন্য প্রথমে চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয় এবং ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। তখন চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে নতুন জায়গার কথা ভাবা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেও সবাই এ ব্যাপারে একমত হই যে, যেখানেই অনুষ্ঠান করি না কেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের ঠিকানা জানতাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, বিএসএফের গোলক মজুমদার ও শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়।
এদিকে অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল রেডিওতে প্রচারিত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বাংলা ও ইংরেজি করা হয়েছিল। ইংরেজি কপি বিদেশি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছিল। এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা।
আমি আর তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকি, সেই ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় লেখার কাজ করি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখতে হবে। হাতের কাছে নেই কোনো বই বা অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো কপি। আমেরিকার ইনডিপেনডেন্স বিল অনেক আগে পড়েছিলাম। চোখের সামনে ভাসছিল সেই অরিজিনাল কপি আর বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছু মনে নেই। অবশ্য বেশি কিছু মনে করার চেষ্টাও করলাম না। শুধু মাথায় রাখার চেষ্টা করলাম কী কী পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে এবং ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া চূড়ান্ত করে ফেললাম। প্রেসিডেন্ট যেহেতু অনুপস্থিত, স্বাধীনতার ঘোষণায় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।
চূড়ান্ত খসড়াটি তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালে তিনি পছন্দ করেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো বড় আইনজীবীকে দেখিয়ে নিতে হবে। কারণ, আমরা যুদ্ধে নেমেছি, ঘোষণাপত্রে কোনো রকমের আইনি ফাঁক থাকা চলবে না। কলকাতা হাইকোর্টের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, সুব্রত রায় চৌধুরী ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখলেন। দেখে তিনি লাফিয়ে উঠলেন এবং বললেন, কোনো কোলন, সেমিকোলনও পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। এটা ছিল রায় চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। এরপর অবশ্য তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। সময়ে-অসময়ে তার কাছে ছুটে যেতাম। তিনিও ছোট ভাইয়ের মতো পরামর্শ, সাহায্য-সহযোগিতা করছেন।
১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের কাছে ওসমানীর গায়ের মাপের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। রাতের মধ্যে দর্জি ডেকে, কাপড় কিনে তার জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। আমার আর আবদুল মান্নানের ওপর পড়ল শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার দায়িত্ব। প্রথম বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কলকাতা প্রেস ক্লাবে মিলিত হই, সেটা ছিল ১৬ এপ্রিলের ঘটনা। প্রেস ক্লাব লোকে লোকারণ্য, তিলধারণের ঠাঁই নেই। ক্লাবের সভাপতি সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা অনুরোধ করলাম, আমাদের উপস্থিতির কথা আপাতত গোপন রাখতে হবে। এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পরদিন ভোরে ডাকা অনুষ্ঠানে হাজির হতে অনুরোধ জানাই।
বিএসএফ থেকে ১০০টি গাড়ি নেওয়া হলো। সাংবাদিকদের জন্য ৫০টি। অন্যগুলো আওয়ামী লীগের এমপি, এমএলএ ও নেতাদের জন্য। রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দিতে থাকলাম। কোথায় যাচ্ছেন তা জানতে না চাওয়ার জন্য বলা হলো। শুধু বলে দিলাম, সকালে আমরা একসঙ্গে হব। গাড়ি চালকদের বলে দেওয়া হলো, তারাই পৌঁছে দেবেন নির্দিষ্ট স্থানে। লোক জানাজানির ভয়ে এই ব্যবস্থা।
সারা রাত ঘুমাইনি, ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ওসমানী গাড়িতে করে রওয়ানা হয়ে যান। রুম থেকে ঘোষণাপত্রের কাগজপত্র নিয়ে আমি ও আবদুল মান্নান প্রেস ক্লাবে গিয়ে দেখি, সেই কাকডাকা ভোরেও তিলধারণের ঠাঁই নেই। সাংবাদিকদের জানানো হলো, স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। তাদের নিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম। আম্রকাননে পৌঁছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেন। এবং আগেই ঠিক করা ছিল, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ, ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন।
কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটি ছোট্ট মঞ্চে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবদুল মান্নান। সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিচালনায় শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত আম্রকানন বা মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আম্রকাননের নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর।
লেখক: ব্যারিস্টার ও রাজনীতিবিদ
সৌজন্যে: সারাবাংলা.নেট