কাশ্মিরের কাঠুয়ায় যাযাবর মুসলিম বাকারওয়াল গোষ্ঠীর ৮ বছর বয়সী শিশু আসিফা বানুকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার শুরু হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আদালতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছে অভিযুক্তরা।
আজ সোমবার (১৬ এপ্রিল) কাঠুয়ার দায়রা জজ আদালতে আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বিচার শুরু হয়। এ দিন অভিযুক্তরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে জেলা ও দায়রা বিচারকের কাছে নারকো পরীক্ষার আবেদন জানায়।
জেলা ও দায়রা বিচারক রাজ্য ক্রাইম ব্রাঞ্চকে অভিযুক্তদের চার্জশিটের কপি দিতে বলার পাশাপাশি ২৮ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে। এ মমলায় কাশ্মির সরকার দুইজন শিখ কৌঁসুলীকে নিয়োগ দিয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু জানায়, মামলায় অভিযুক্ত কিশোর আলাদাভাবে জামিন চেয়েছে। এ ব্যাপারে ২৬ এপ্রিল সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
এ বছরের জানুয়ারিতে কাঠুয়ার উপত্যকায় ঘোড়া চড়ানোর সময় অপহরণ করা হয় আসিফাকে। আদালতে দায়ের করা মামলার বিবরণ অনুযায়ী, আসিফা নামের ওই শিশুকে অপহরণের জন্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও দেবীস্থান মন্দিদের হেফাজতকারী সানজি রামই তার ভাগ্নে ও একজন পুলিশ সদস্যকে নির্দেশ দেয়। নির্দেশ বাস্তবায়নের পর সাত দিন ধরে মন্দিরে আটকে রেখে একদল হিন্দু পুরুষ ধর্ষণ করে আসিফাকে। পরে মাথায় পাথর মেরে ও গলা টিপে হত্যা করা হয় তাকে। আসিফাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটজনকে অভিযুক্ত করেছে ভারতের আদালত। মধ্য জানুয়ারির ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) দিন অভিযোগপত্র জনসম্মুখে আনা হয়। জানুয়ারিতে এ নিয়ে তেমন উত্তেজনা না হলেও এ ঘটনায় অভিযোগপত্র দেওয়ার পর সোচ্চার হয়ে ওঠে বলিউডসহ সারা ভারত।
উল্লেখ্য, নারকো এনালাইসিসের ক্ষেত্রে স্নায়ু শিথিলকারী সোডিয়াম পেন্টোথাল অথবা স্কোপোলামাইন ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয়। অভিযুক্ত অথবা সন্দেহভাজন ব্যক্তির শিরায় সিরিঞ্জের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এর প্রভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি আধা সচেতন এবং আধা অচেতন অবস্থায় থাকে; তাকে তখন একের পর এক প্রশ্ন করা হতে থাকে। ঘোরের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে সে। এগুলোকে তার অবচেতন মনের গোপন কথা বলে ধরে নিয়ে উত্তরগুলোকে সত্য বলে ধারণা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রকে উদ্ধৃত করে এনডিটিভি জানায়, অভিযোগপত্রের একটিতে সাত অভিযুক্তের নাম আছে। আরেকটিতে অভিযুক্ত কিশোরের নাম আছে। আইন অনুযায়ী কাঠুয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রাপ্তবয়স্ক সাতজনের বিচার দায়রা জজ আদালতে শুরু করছেন। আর কিশোর অপরাধ আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অভিযুক্ত কিশোরের বিরুদ্ধে বিশেষায়িত আদালতে বিচার হবে। অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী দুই ধর্মের হওয়ায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা বলে হিন্দু-মুসলিম কৌঁসুলি নিয়োগ দেয়নি জম্মু-কাশ্মির সরকার। মামলার স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে দুই শিখ সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অপরাধ শাখার দায়ের করা অভিযোগপত্রে অপহরণ,ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,এলাকা থেকে সংখ্যালঘু যাযাবর সম্প্রদায়কে নির্মূল করে দিতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অভিযোগপত্রে দেবীস্থান মন্দিরের কেয়ারটেকার সানজি রামকে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সানজি রাম ছাড়াও বিশেষ পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া ও সুরেন্দর ভার্মা, সানজি রামের বন্ধু পরভেশ কুমার, সানজির ভাতিজা (কিশোর অপরাধী) এবং সানজির পুত্র বিশাল জনগোত্রার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা এবং প্রধান কনস্টেবল তিলক রাজ, সাব-ইন্সপেক্টর আনন্দ দত্তের নামও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা সানজি রামের কাছ থেকে ৪ লাখ রুপি ঘুষ নিয়ে অপরাধের প্রমাণ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এ আট অভিযুক্তকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে গত মার্চে হিন্দু একতা মঞ্চ নামে একটি সংগঠন সমাবেশ আয়োজন করেছিল। সেখানে ভাষণ দিয়েছিলেন, কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী মাহবুবা মুফতি সরকারের শিল্পমন্ত্রী চন্দ্র প্রকাশ গঙ্গা এবং বনমন্ত্রী লাল সিং। এ দুই বিজেপি নেতা অভিযুক্তদের মুক্তির দাবি জানান। চন্দ্র প্রকাশ গঙ্গা অভিযুক্তদের গ্রেফতার নিয়ে বলেন, ‘এ এক মেয়ের মৃত্যু নিয়ে কেন এতো শোরগোল… এখানে এমন অনেক মেয়ে মারা যায়।’
আসিফা হত্যার ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের পর মাহবুবা মুফতি সরকার থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন ওই দুই বিজেপি নেতা। মোদি বলেছিলেন, ‘আমি দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাই যে কোনও দোষীকেই ছাড় দেওয়া হবে না। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের মেয়েরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে।’
অভিযুক্তদের পক্ষে সম্প্রতি র্যালি করেছিল দ্য জম্মু বার অ্যাসোসিয়েশনও। অভিযোগপত্র দায়েরে বাধাও দিয়েছিল তারা। পুলিশের তদন্তে সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়েছে জম্মু বার অ্যাসোসিয়েশন। এ ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি করে ১২ দিনের ধর্মঘটও পালন করছেন আইনজীবীরা। এদিকে রাজ্যের ল’ ইয়ার’স অ্যাসোসিয়েশন বরাবর একটি নোটিশ ইস্যু করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বার কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এর চেয়ারম্যান মনন কুমার মিশরা বলেন, ‘যদি কোনও আইনজীবীকে দোষী পাওয়া যায়, তবে আজীবনের জন্য তার লাইসেন্স বাতিলের অধিকার আমাদের আছে।’