বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরীকে পরম মমতায় দুপুরের খাবার তুলে দিচ্ছেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) শিক্তা রাণী রায়। মাত্র দুই দিন আগে পহেলা বৈশাখের দিন খানজাহান আলী থানা থেকে ওই কিশোরীকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আনা হয়েছে।
খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানা কম্পাউন্ডে অবস্থিত বিভাগের একমাত্র ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, নাম ঠিকানাবিহীন ১৫/১৬ বছরের কিশোরীটিকে মাতৃতূল্য মমতায় যত্ন নিয়ে খাওয়াচ্ছেন এসআই শিক্তা।
তিনি জানান, খানজাহান আলী থানা পুলিশ বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটিকে রাস্তায় ঘুরতে দেখে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। মেয়েটি রাত-দিন রাস্তায় থাকে, কখন কার লালসার শিকার হয় সে আশঙ্কায় তাকে উদ্ধার করে এখানে আনা হয়। মেয়েটির নাম-ঠিকানা উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। মেয়েটি নিজে থেকে কোনো কাজ করতে পারে না। সব কাজই করে দিতে হয়।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ও ভিকটিম সাপোর্টের ইনচার্জ সোনালী সেন গণমাধ্যমকে বলেন, এই কিশোরীটির মতো শত শত অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারটি। চলতি বছরের গত তিনমাসে প্রায় শতাধিক নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সহায়তা প্রদান করা হয়েছে এ সেন্টার থেকে।
তিনি জানান, মহানগরীর খালিশপুর এলাকার একটি মেয়েকে একটি ছেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দৈহিক মেলামেশা শুরু করে। এক সময় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এরপর থেকে ছেলেটি তাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। বিষয়টি ওই এলাকার কাউন্সিলর ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানায় মেয়েটি ও তার পরিবার। স্থানীয়দের শালিসীতে ছেলেটি মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি হয়। কিন্তু পরে ছলচাতুরি করতে থাকে। বিয়ের চাপ দিলে ৫০ হাজার টাকায় বিষয়টি মীমাংসা করতে চায়। মেয়েটি রাজি না হয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ফোন দেয়। পরে মেয়েটিকে ভিকটিম সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে তাকে আশ্রয়সহ আইনের সহায়তা থেকে শুরু করে তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। প্রতারকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে খালিশপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
এ মামলায় ছেলেটিকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। মেয়েটি বর্তমানে তার বাড়িতে রয়েছে। ভিকটিম সেন্টারের সাথে সমাজ সেবা ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি এনজিও সংযুক্ত রয়েছে। তারা মেয়েটিকে সকল সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
সোনালী সেন বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার যেসব দায়িত্ব পালন করে সেগুলো হচ্ছে- ভিকটিমকে সাদরে গ্রহণ করা। তার কথা মনযোগ দিয়ে ও সতর্কতার সাথে শোনা। অশ্লীলভাবে প্রশ্ন না করা বা অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করা। জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া। ভিকটিমকে আশ্বস্ত করা। অপরাধীকে বিলম্ব ছাড়াই আইনের আওতায় নিয়ে আসা। আর সেবার মধ্যে রয়েছে- পাঁচ দিন বিনামূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। খাবার ও পোশাক দেওয়া হয়। ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দেওয়া হয়। আইনী সহায়তার জন্য মহিলা আইনজীবী দ্বারা কাউন্সেলিং করা হয়। নারী পুলিশ দ্বারাপরিচালিত হওয়ায় শিশু ভিকটিমদের মাতৃস্নেহে লালন করা হয় এবং নারী ভিকটিমরা তাদের সমস্যা নিঃসংকোচে বলতে পারে। শিশুসহ মাকে আশ্রয় ও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। নারী পুলিশ ও সহযোগী এনজিওদের অংশীদারিত্বে সেবা দেওয়া হয়। সহযোগী এনজিও কর্তৃক পুনবার্সন করা হয়। হারানো শিশুদের অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা না গেলে অথবা কোনো কারণে বৈধ অভিভাবক না পাওয়া গেলে সেন্টারটি থেকে এনজিওর মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে পুলিশ রিফর্মস প্রকল্পের আওতায় দেশের ৭টি বিভাগীয় শহরে একটি করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানার পাশে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কার্যক্রম শুরু করা হয়। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারসহ ১৮জন জনবল কাজ করছে। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সোনালী সেনসহ ১৮জন জনবল বর্তমানে এ সেন্টারে সেবা দিচ্ছেন। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের থাকার জন্য আটটি বেড রয়েছে, যার মধ্যে নারীর বেড সংখ্যা ৬টি। এখানে ৫ দিন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশের পাশাপাশি মেরিস্টপ, ওয়ার্ল্ডভিশন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট),অপরাজেয় বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মহিলা আইনজীবী সমিতি ও জেজেএস এই ৭টি এনজিও আইনি সহায়তাসহ অন্যান্য কাজ করছে। বাংলানিউজ