চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে ১ হাজার ৮৭৪টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে ১ হাজার ১৩৬টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৭৩৮টি। দুটি আদালতই বিচারকশূন্য রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে দুটি আদালতেই বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। ফলে গত চার মাসে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি।
চট্টগ্রাম জেলা ছাড়াও প্রথম শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলা। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলা।
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি সরকারি বাড়িতে দুটি শ্রম আদালতের কার্যক্রম চলে। আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩৯টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে একই সময়ে নিষ্পত্তি হয় ১২৯টি মামলা।
চট্টগ্রাম দ্বিতীয় শ্রম আদালতের বিচারক (চেয়ারম্যান) মফিজুল ইসলাম ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর অবসরে যান। সেদিন থেকে বিচারকশূন্য রয়েছে আদালতটি। যে কারণে প্রথম শ্রম আদালতের বিচারক (চেয়ারম্যান) মোক্তার আহমদ একসঙ্গে দুটি আদালতের দায়িত্ব পালন করতেন। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনিও অবসরে যান।
চাকরিতে পুনর্বহাল, পাওনা আদায়, মালিক-শ্রমিক চুক্তির লঙ্ঘন, বেতন-ভাতার দাবি, ক্ষতিপূরণ আদায় এবং ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত মামলা শ্রম আদালতে করা হয়। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক শ্রম আদালতের বিচারক (শ্রম আদালতের কার্যক্রমে বিচারককে বলা হয় চেয়ারম্যান) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে বিচারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রতি দুই বছর পর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় ছয়জন করে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়।
আইনজীবীরা জানান, শ্রম আদালতে মামলা করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে কী হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ঢাকায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়।
চাকরিতে পুনর্বহাল চেয়ে ২০১১ সালের ১৮ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ছোটলেখা চা-বাগানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম দ্বিতীয় শ্রম আদালতে মামলা করেন বাগানটির শ্রমিক খলিল মিয়া। এরপর ছয় বছর ১১ মাস কেটে গেছে, কিন্তু মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। বাদী খলিল মিয়া বলেন, এ পর্যন্ত ৫৭ বার মামলার তারিখ পড়েছে। বিচারক না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে শুনানি হয়নি।
ছোটলেখা চা-বাগানের পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন আইনজীবী আশীষ কুমার দত্ত। তিনি বলেন, শ্রম আদালত বছরের বেশির ভাগ সময় বিচারকশূন্য থাকে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগছে।
খলিল মিয়ার মতো অনেক শ্রমিকই মামলা নিষ্পত্তির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচারকশূন্যতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে বিলম্ব, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে বিলম্বের কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে।
বিচারকের পাশাপাশি তিন বছর ধরে চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে রেজিস্ট্রারও নেই। প্রথম শ্রম আদালতের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা তারিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বিচারকশূন্যতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ৬ মে এখানে নতুন বিচারক যোগদান করার কথা রয়েছে।
মিরসরাইয়ের দেলোয়ার হোসেন নামের এক শ্রমিক ২ লাখ ৮ হাজার টাকা পাওনা আদায়ের জন্য ২০১০ সালের ২২ জুলাই প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন মেসার্স গিয়াস সমিল অ্যান্ড ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে। সাড়ে সাত বছরে মামলাটির ৫৬টি তারিখ পড়েছে। দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
ফাতেমা বেগম নামের এক নারী শ্রমিক জিয়া সার কারখানা কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে ২ লাখ ৮ হাজার টাকা পাওনা আদায়ের জন্য ২০০৯ সালের ২২ এপ্রিল দ্বিতীয় শ্রম আদালতে মামলা করেন। মামলার রায় দেখে যেতে পারেননি তিনি। ২০১১ সালের ৪ আগস্ট মারা যান ফাতেমা। নয় বছরে মামলাটির ৭৭টি তারিখ পড়েছে। তিনি মারা যাওয়ার পর ২০১৬ সালে তাঁর দুই ছেলে মো. সালাউদ্দিন ও বছির মিয়া এবং এক মেয়ে আমেনা খাতুন মামলায় পক্ষভুক্ত হন। এখন তাঁরাই মামলাটি পরিচালনা করছেন। বাদীর আইনজীবী এ কে এম মহসিন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আদালত প্রায়ই বিচারকশূন্য থাকে। এ কারণে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি হয় না। প্রথম আলো