আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে। যা ‘জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তাকারী সুরক্ষার জন্য নীতিমালা- ২০১৮’ হিসেবে প্রণয়ন করেছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, জরুরি শল্যচিকিৎসার (অপারেশন) প্রয়োজন পড়লে উপযুক্ত অভিভাবক বা আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে ও সম্মতি ব্যতিরেকেই প্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসা দেয়া যাবে।
এক্ষেত্রে আহত ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা থাকলে বা জীবনহানি ঘটলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। অন্যদিকে চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করলে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে যিনি বা যারা নেবেন তাদের কোনোভাবে হয়রানি করা যাবে না।
মামলার ভয়ে অনেক সময় সাধারণ মানুষও আহতকে যেমন উদ্ধার করে না, হাসপাতালও দায় এড়াতে চায়। এ নীতিমালার ফলে সমস্যাটি কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এর আগে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা- ২০১৭ এর খসড়া করা হয়েছিল। এরপর পরিমার্জিত খসড়ায় ‘সহায়তাকারী সুরক্ষা প্রদান’ সংযুক্ত করা হয়। ওই খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য কপিটি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে চলতি মাসের প্রথমদিকে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দাখিল করা হয় বলে গণমাধ্যমকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. জাকির হোসেন রিপন।
আদালতে দাখিল করা নীতিমালা বিচারতিরা পর্যালোচনা করছেন এবং আগামী মাসেই আদালতের সিদ্ধান্ত জানানো হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত জানার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন আদালত। এরপরই তা চূড়ান্ত আকারে সরকার প্রকাশ করতে পারে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জাকির হোসেন রিপন এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। মন্ত্রণালয়ের ওই কপি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। কোর্টের অবকাশ শেষ হলে আশা করি মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিষয়টি আদালত চূড়ান্ত করবেন। এরপর আদালতের দেয়া নির্দেশনা সরকারকে জানিয়ে দেয়া হবে।’
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে-
- আহতকে হাসপাতালে আনার পর জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে।
- চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির অবহেলা বা শৈথিল্য অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন/লাইসেন্স/অনুমতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে।
- নীতিমালা বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে একটি জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সেলও গঠন করবে সরকার।
নীতিমালায় আহত ব্যক্তি নিজেই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে চিকিৎসাসেবা দেয়ার আগে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া যাবে না। একজন পুলিশ কর্মকর্তা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আগে আহত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত যানবাহনের ব্যবস্থা করবেন।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা সুবিধা বা সক্ষমতা না থাকলে রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য লিখতে হবে। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে (গোল্ডেন আওয়ার) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিজ দায়িত্বে উপযুক্ত চিকিৎসা সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে স্থানান্তর করবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতাসম্পন্ন হাসপাতাল কোনো অবস্থায়ই রোগীর চিকিৎসা প্রদান ব্যতিরেকে ফেরত বা স্থানান্তর করতে পারবে না। জরুরি শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন পড়লে উপযুক্ত অভিভাবক বা আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে ও সম্মতি ব্যতিরেকেই প্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসা প্রদান করা যাবে। এ ক্ষেত্রে আহত ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা থাকলে বা জীবনহানি ঘটলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, আহতকে হাসপাতালে নেয়া ব্যক্তি বা সহায়তাকারী ব্যক্তিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই আটক বা অন্য কোনোভাবে হয়রানি করতে পারবে না। সহায়তাকারীকে তার পরিচয় বা টেলিফোন নম্বর দিতে বাধ্য করা যাবে না। তবে স্বেচ্ছায় তথ্য দিলে তা লিখে রাখবে এবং সংরক্ষণ করবে। এ তথ্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে।
হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে দেশের সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে, জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া এবং চিকিৎসা না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোথায় অভিযোগ করবে সে বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করতে সরকারকে নির্দেশ দেন।
মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সৈয়দ সাইফুদ্দিন কামাল নামের এক ব্যক্তির করা রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই নির্দেশনা দেন আদালত।
২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি আরাফাত নামের এক ব্যক্তি বাসে উঠতে গিয়ে পা পিছলে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন। তাকে নিকটস্থ তিনটি হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এরপর পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে তিনি মারা যান।
ওই ঘটনায় হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, এ ধরনের দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিদিনই চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মারা যাচ্ছে সাধারণ নাগরিকরা। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা প্রয়োজন।
বিষয়টি আদালতের নজরে আনা ব্যক্তির (রিট আবেদনকারী) আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম গণমাধ্যমকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে দেশে কোনো আইন বা নীতিমালা ছিল না। এই প্রথম সরকার একটি নীতিমালা করেছে। এটা অবশ্যই বড় অর্জন। এখন আদালত বিষয়টি চূড়ান্ত করে দেয়ার পর সরকার তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ভাবতো, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। কিন্তু এ নীতিমালা করায় বেসরকারি হাসপতালগুলো চিকিৎসা দিতে বাধ্য থাকবে। আহত ব্যক্তির অর্থ না থাকলেও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল নিজ খরচে চিকিৎসাসেবা দিতে বাধ্য হবে।’
তিনি আরও বলেন, আশা করি আদালত এক-দুই মাসের মধ্যেই বিষয়টি চূড়ান্ত করে দেবেন।