ছবি - বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

সুপ্রিম কোর্টে পাঁচ শতাধিক দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

 

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক ) কর্তৃক দায়েরকৃত দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীদের পাঁচ শতাধিক মামলা আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের রায়ের আলোকে ২৭টি মামলা পুনঃবিচারের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারিক আদালতের সাজা হয়েছে এমন শতাধিক মামলা এবং হাইকোর্টে নিম্ন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এ ধরনের তিন শতাধিক (ব্যুরো আমল থেকে) এবং আপীল বিভাগে শতাধিক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

অন্যদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলায় খালাস ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপহার সামগ্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের সাজার রায় বাতিল করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে খালাস দিয়েছে হাইকোর্ট। এ দুটি মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপীল করেনি। অন্যদিকে দুদকের মামলায় তারেক রহমানের সাজা হলেও লন্ডনে অবস্থানের কারণে দণ্ডের বিরুদ্ধে আপীল করেননি। তিনি আপীল করতে পারেন যদি যদি দেশে এসে আত্মসমর্পণ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এ দিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন দ্রুত মামলাগুলি নিষ্পত্তি হচ্ছে। আমি আশা করছি কয়েক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তিতে শতভাগ সফলতা আসবে।

এ ছাড়া এম মোর্শেদ খানসহ এবি ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং দুর্নীতি মামলায় তদন্ত চলছে। এম এ হাসেমের দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে বিচারিক আদালতে। মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মামলার আলোকে সচিবের নোটিস দেয়ার এখতিয়ার নেই বলে হাইকোর্ট বেশ কিছু মামলা থেকে আসামিদেরকে খালাস করে দেয়। পরবর্তীতে আপীল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয় সচিবের এ ধরনের নোটিস দেয়ার এখতিয়ার আছে। সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়ের আলোকে এমন ২৭টি মামলা পুনঃবিচারে পাঠানো হয়।

এ দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দুদকের ৫টি মামলাসহ প্রায় ৩৭টি মামলা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে বগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা রায় হলেও অন্য চারটি মামলা চলছে। যার মধ্যে রয়েছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, বড় পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা । এর বাইরে আরও ঢাকাসহ বিভিন্ন আদালতে মামলা রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য আগামী ১০ মে এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আদালত। একই সঙ্গে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এ মামলায় খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হয়েছে। নাইকো দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্যে আগামী ১৩ মে দিন ধার্য করেছেন আদালত। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ২৬ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করা ও ভুয়া জন্মদিন পালন করার অভিযোগে মানহানির দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির জন্য ১৭ মে দিন ধার্য করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকগণ এ দিন ধার্য করেছেন।

ওয়ান ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়াকে যে সম্পদের মামলায় নোটিস দেয় দুদক, সেই নোটিসের চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এ রিট শুনানির জন্য একটি দ্বৈত বেঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া আপীল করেন। সেখানে অপর্যাপ্ত সাজার কারণে দুদক আরেকটি রিভিশন দায়ের করে। হাইকোর্ট কেন সাজা বাড়ানো হবে না এ বিষয়ে রুল জারি করে। সেই রুলটি আপীলের সঙ্গে শুনানির জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার জামিন আবেদন বর্তমানে আপীল বিভাগে বিচারাধীন। আগামী ৮ মে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ আছে।

দুদকের মামলা প্রসেঙ্গ এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, দুদক তার নিজস্ব গতিতে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বিচারিক আদালতের রায়ে দুদকের মামলায় সাজার পরিমাণ ৭০ ভাগের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে দুদক আইনবিধি মেনে এবং উচ্চতর আদালতের পর্যবেক্ষণের আলোকে দুদক তদন্তে ও মামলায় দ্রুত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। দুদকের লক্ষ্যটা কী এর জবাবে তিনি আরও বলেন, কাক্সিক্ষত লক্ষ্যটা হলো দুদকের মামলা শতভাগ সফলতা অর্জন।

ওয়ান ইলেভেনের সময় ২৭টি মামলা দুদকের সচিব হাইকোর্ট ডিভিশনে নোটিস দিয়েছিলেন। সে কারণে মামলাগুলো থেকে আসামিদের খালাস করে দেয়। সেগুলো পুনঃবিচারের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখযোগ্য মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইকবাল আহাসান মাহমুদ টুকু, আমান উল্লাহ আমান, গিয়াস উদ্দিন আল মাহমুদ, হাফিজ ইব্রাহিম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, জয়নাল আবেদীন হাজারী, আলহাজ মকবুল আহম্মেদ, হাজী মোঃ সেলিম, ইঞ্জিনিয়ার মনজুর আহম্মেদ মোরশেদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, ব্যারিস্টার সিগমা হুদা, মীর মোঃ নাসির উদ্দিন, মীর মোঃ হেলাল উদ্দিন প্রমুখ। এর মধ্যে তিনটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা (ঘুষের মামলা) হাইকোর্ট সাত বছর থেকে চার বছরের সাজা দিয়েছে। হাফিজ ইব্রাহিমকে সাজা বহাল রেখে অর্থদণ্ড কমিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার মনজুর আহম্মেদ মোরশেদকে হাইকোর্ট খালাস দিয়েছে দুদক সেখানে লিভ টু আপীল করেছে ।

এ ছাড়া ওয়ান ইলেভেনের সময় বেশ কয়েকটি মামলার সাজা হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগ বহাল রেখেছে। যার মধ্যে রয়েছে ওসমান গনি, ডাঃ জাফর উল্লাহ চৌধুরীর ভাই নাজিম উল্লাহ চৌধুরী। বিশেষ আদালত তাকে ৫ বছরে সাজা দিয়েছিল। হাইকোর্ট সেখানে তিন বছর সাজা প্রদান করে। আপীল বিভাগ তার রায়ে বলেন, যতদূর সাজা খেটেছে ততদূর পর্যন্ত এটাই সাজা। কিন্তু জরিমানাটা দিতে হবে। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ঘুষের মামলায় হাইকোর্ট ৭ বছর থেকে চার বছরের সাজা দিয়েছে। এখনও রায়টি দুদক পায়নি। হাফিজ ইব্রাহিমকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ ইব্রাহিমকে ৫০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাফিজ ইব্রাহিমের আবেদন আংশিক মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। তথ্য গোপনের অভিযোগে তার তিন বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি দুই বছরের বেশি সাজা খেটে ফেলায় তাকে আর বাকি সাজা খাটতে হবে না। তবে তাকে ৫০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ডের ও আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে হাফিজ ইব্রাহিমকে খালাস দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মানি লন্ডারিং মামলায় গিয়াস উদ্দিন মামুনকে নিম্ন আদালত ৭ বছরের সাজা প্রদান করে এবং তারেক রহমানকে খালাস দেয়। সেখানে হাইকোর্ট হাফিজ ইব্রাহিমের সাজা বহাল রাখে পাশাপাশি তারেক রহমানকে ৭ বছরের সাজা প্রদান করা হয়। আর উভয়ের অর্থদণ্ড ২০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়।

অন্যদিকে ওয়ান ইলেভেন ও বর্তমান সময়ে হাইকোর্টে যাদের বিরুদ্ধে সাজা হয়েছে তার বিরুদ্ধে দুদক শতাধিক মামলা আপীল করেছে। সেগুলি বর্তমানে আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমান উল্লাহ আমান, সাবেরা আমান, মীর মোঃ নাসির উদ্দিন, মীর মোঃ হেলাল উদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, হাজি সেলিম, জয়নাল আবেদীন হাজারী, হাজী মকবুল আহম্মেদ। বর্তমান সময়ে যাদের মামলাগুলো আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া, কাজী সলিমুল হক কামাল, শরফুদ্দিন আহম্মেদ, আব্দুর রহমান বদী।

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৫ আসামিকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের সবার ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা করে জরিমানা করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী (পলাতক) এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান (পলাতক)। একইসঙ্গে তাদের সবার ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা করে জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই অর্থপাচারের মামলায় নিম্ন আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি জরিমানা প্রদান করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তারেকের বন্ধু ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ড ও বহাল রাখা হয়েছে। তবে তাকে বিচারিক আদালতের দেয়া ৪০ কোটি টাকার অর্থদণ্ড কমিয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের দায়েরকৃত জিয়া অরফানেজ মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তারেক এ রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপীল করেননি। জনকণ্ঠ