নতুন আইনজীবী হলেন ৫৩২৯ জন
বার এক্সাম (প্রতীকী ছবি)

বার কাউন্সিল সনদ জটে হতাশায় ১২ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী

 

অ্যাডভোকেটশীপ লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় সাত মাস অতিবাহিত হলেও এখনো ফলাফল প্রকাশ করতে পারেনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। ফলে বার কাউন্সিল সনদ জটে হতাশায় ভুগছেন প্রায় ১২ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী।

মুন্সীগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিসিএস, ব্যাংক কিংবা নন ক্যাডার কোনো পরীক্ষাতেই চেষ্টা করেননি তিনি। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মোয়াজ্জেম ভর্তি হন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি আইন কলেজে। ২০১৫ সালে আইন পাস করেন। এরপর শুরু হয় বার কাউন্সিল সনদ অর্জনের লড়াই। সনদের জন্য জজ কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। টানা তিন বছর ধরে আদালতের বারান্দায় যাওয়া-আসা করছেন। কিন্তু এখনো নামের আগে লিখতে পারেননি ‘অ্যাডভোকেট’ পদবি। এর কারণ, বার কাউন্সিল ২০১৫ সালে আইন পাস করা শিক্ষার্থীদের অ্যাডভোকেট সনদ প্রদান করতে পারেনি।

গত বছরের ১৪ই অক্টোবর অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফল এখনো প্রকাশ করতে পারেনি। ফলে সনদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী। পরীক্ষার ফল প্রকাশে দেরি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা জানান, সনদ পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করেন হাইকোর্টের বিচারপতিরা। প্রতিটি খাতা দু’বার করে মূল্যায়ন করতে হয়। এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক বেশি। তাই ফলাফল প্রকাশে দেরি হচ্ছে। তবে দ্রুত লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য জজ কোর্টের কিছু বিচারক খাতা মূল্যায়ন করেছেন । তারপরও দেরি হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ফল প্রকাশে এত সময় মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই। এর দায়িত্ব মূলত এনরোলমেন্ট কমিটি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের।

এদিকে শিক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার কোনো নির্দিষ্ট তারিখের কথা জানা না গেলেও ১৪ই মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বার কাউন্সিলের নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইতিমধ্যে প্রার্থীরা তাদের মনোনয়নপত্রও দাখিল করেছেন।

বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা তিন ধাপে হয়ে থাকে। প্রথম ধাপে একজন শিক্ষার্থীকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে হয়। প্রিলিমিনারিতে যারা পাস করেন তারা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। লিখিত পরীক্ষায় যারা পাস করবেন তারা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। এরপর আইনজীবী তালিকাভুক্তির চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়।

২০১৭ সালের ২১শে জুলাই ৩৪৫০০ শিক্ষার্থী নৈর্ব্যক্তিক (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১১ হাজার ৮৪৬ জন পরীক্ষার্থী কৃতকার্য হন। পরে ওই বছরের ১৪ই অক্টোবর তারা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু গত প্রায় ৭ মাসেও প্রকাশ হয়নি লিখিত পরীক্ষার ফলাফল। কবে ফলাফল প্রকাশ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এতে মোয়াজ্জেমের মতো হাজারো শিক্ষানবিশের দিন কাটছে চরম হতাশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে।

বরিশালের জাকির হোসেন বলেন, ২০১২ সালে আইন পাস করে ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করছি। গ্রামের লোকজন জানে আমি বড় উকিল। বেশ আয়-রোজগার করি। কখনো কখনো মা-বাবাও তাই মনে করেন। অথচ এই বৈশাখেও মা-বাবাকে একটি নতুন কাপড়ও দিতে পারিনি। এজন্য ছুটি থাকা সত্ত্বেও গ্রামে যাইনি।

আরেক ভুক্তভোগী সাব্বির হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছর যে সংখ্যক আইনের ছাত্র পাস করছে সেই অনুপাতে আইনজীবী হওয়ার সংখ্যা একেবারেই কম। যার ফলে আইনে পাস করা শিক্ষার্থীদের বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। পেশা জীবনে প্রবেশ করতে না পেরে এখন জীবনের প্রতি হতাশা কাজ করছে। আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করবো বলেই অন্য কোনো চাকরিতেও চেষ্টা করিনি।’

শিক্ষানবিশ আইনজীবী ফারিয়া ইসলাম বলেন, ‘আইন পড়া শেষ করেছি ২০১৩ সালে, এখন চলে ২০১৮। লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে ৬ মাসের বেশি। কিন্তু এখনো ফল প্রকাশ হয়নি। পরীক্ষায় পাস না করলে আবার প্রস্তুতি নিতে হবে। সেটাও হচ্ছে না।’

এদিকে অ্যাডভোকেট সনদপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতার জন্য বর্তমানে বার কাউন্সিলের পরীক্ষা পদ্ধতিকেও দায়ী করছেন অনেক পরীক্ষার্থী। তাদের মতে অন্য পেশায় সনদের জন্য এত পরীক্ষার প্রয়োজন না হলে আইন পেশায় কেন তা হবে?

তরুণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইবরাহিম আবীর ইবু বলেন, একজন শিক্ষার্থীকে ৪ বছর আইন পড়ার পর সনদের জন্য এতগুলো পরীক্ষা দেয়ার কোনো মানে নেই। হয় নৈর্ব্যক্তিক না হয় সৃজনশীল লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে এই ফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা দূর করা সম্ভব।

সিলেটের কামাল হোসেন গত বছর লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। নবীন এই আইনজীবী বলেন, অন্য কোনো পেশার লোকজনকে আমাদের মতো সনদের জন্য এতসব পরীক্ষা দিতে হয় না। একজন চিকিৎসক এমবিবিএস পাস করার পর ৬ মাস ইন্টার্নি করার পর তিনি ডাক্তারি করতে পারেন। একজন শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর সিনিয়র প্রকৌশলীর সঙ্গে প্র্যাকটিস করার পর সেও ইঞ্জিনিয়ারিং করতে পারে। তাহলে আমরা কেন নয়?

ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম সোহেল বলেন, পরীক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন করেন হাইকোর্টের বিচারপতিরা। স্বল্প বিচারপতির কারণে হাইকোর্টে অনেক মামলাই পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে। তাই খাতা মূল্যায়নের জন্য জজ কোর্টের বিচারপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেও দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।