তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলার বিচারের জন্য দেশে একটি মাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো এজলাস বা আদালতকক্ষ দেওয়া হয়নি। মামলার নথি সংরক্ষণের জন্য নেই সেরেস্তাকক্ষ। বিচারক আছেন, প্রতিদিন মামলাও পরিচালনা করেন। তবে পাশের কোনো আদালতকক্ষে বিচারকাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয় তাঁকে।
একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালটি ঢাকায়। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের ষষ্ঠ তলায় বিচারকের খাসকামরা রয়েছে; কিন্তু কোনো এজলাস নেই। বিশেষ জজ আদালত-১ ও বিশেষ জজ আদালত-৪-এর এজলাসে যখন যেটা ফাঁকা হয় তখন সেখানে বিচারকাজ পরিচালনা করতে হয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারককে। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কোনো দিনই দুপুরের আগে বিচারকাজে বসতে পারেন না সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক। ফলে দূর থেকে আসা বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় প্রতিদিনই।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের ট্রাইব্যুনালের জন্য কোনো এজলাস নেই। অন্য আদালতের সঙ্গে ভাগাভাগি করে বিচারকাজ চালাতে হয়। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে।’ পিপি আরো বলেন, সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ কখন শুরু হবে তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। দুপুর ২টায় বিচারকাজ শুরু করার একটা সময়সীমা দেওয়া আছে। কিন্তু অন্য আদালতের কার্যক্রম ওই সময়ের মধ্যে শেষ না হলে আরো দেরিতে শুরু করতে হয় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। তিনি বলেন, দূর থেকে আসা বিচারপ্রার্থীদের এ জন্য সারা দিনই অপেক্ষা করতে হয়।
২০১৩ সালের ২৮ জুলাই গঠন করা হয়েছিল এই ট্রাইব্যুনাল। গত পৌনে পাঁচ বছরেও একটি নির্দিষ্ট স্থান বা এজলাসের ব্যবস্থা হয়নি। সাইবার ট্রাইব্যুনাল হলেও প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই, সেরেস্তাও নেই। মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের পশ্চিম কোনার ছোট্ট একটি কক্ষে বিশেষ জজ আদালতের নকলখানায় ভাগাভাগি করে দাপ্তরিক কাজ চালান ট্রাইব্যুনালের পেশকার ও কর্মচারীরা। ওই কক্ষে পর্যাপ্ত আসবাবপত্র নেই। নিজস্ব কম্পিউটার না থাকায় নকলখানার কম্পিউটারে ভাগাভাগি করে চালাতে হয় দাপ্তরিক কাজ।
ঢাকার আদালতের সিনিয়র আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, এটি দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু একটি ট্রাইব্যুনালে যেসব আসবাবপত্র থাকতে হয় তা নেই। এজলাসের অভাবে বিচারকাজে গতি আসছে না। দূর-দূরান্ত থেকে বিচারপ্রার্থী আসেন। তাঁদের দিনভর অপেক্ষা করতে হয় মামলার শুনানির জন্য। এটা চরম ভোগান্তি।
মামলার চাপ ও জট বাড়ছে
সাইবার ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বাড়ছে। শুরুতে কম মামলা নিয়ে কাজ শুরু হলেও এখন কয়েক শ মামলা বিচারাধীন। প্রতিদিন নতুন মামলা বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এজলাসের অভাবে বিচারকাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এজলাস ফাঁকা না পাওয়া গেলে শুনানি মুলতবি করতে হয়। অবিলম্বে নিজস্ব এজলাস না হলে মামলাজট বাড়তে থাকবে।
বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি
সাভারের বাসিন্দা মো. মনির হোসেন সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন একটি মামলার আসামি। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। মামলাটির শুনানি ছিল গত ২০ সেপ্টেম্বর। সকাল ১০টায় তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হন। মনির হোসেন জানান, তিনি জানতেন যে দুপুরের পর মামলার শুনানি হবে। কিন্তু সকালেই হাজিরা দাখিল করতে হয়। তাই সাভার থেকে সকালেই এসে থাকতে হয় প্রায় সারা দিন। এটা চরম ভোগান্তি।
রাহেল নামের একজনও একটি মামলায় হাজিরা দিতে আশুলিয়া থেকে আসেন সাইবার ট্রাইব্যুনালে। ইদ্রিস আলী আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে। নওগাঁ জেলার একটি মামলায় হাজিরা দিতে আসেন কুমিল্লার মো. খোরশেদ। তিনজনই জানান, প্রতি শুনানির দিন সকাল ১০টার মধ্যে তাঁদের হাজিরা দিতে হয়। বসে থাকতে হয় বিকেল পর্যন্ত। দূর থেকে আসার পর সারা দিন বসে থাকা ভোগান্তি। রাতের দিকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতে হয়। এটা আরো ভোগান্তি। মাগুরা থেকে আসা আবদুল জলিলের ভাগ্নে একটি মামলার আসামি। রাতের গাড়িতে এসে আবার রাতের গাড়িতে বাড়ি যেতে হয়। ঢাকায় তাঁদের কেউ নেই। রংপুর থেকে ফাতেমা বেগম তাঁর ছেলেকে নিয়ে আসেন সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে। তিনি জানান, রংপুর থেকে আসা-যাওয়া ভোগান্তি তো বটেই; এর ওপর ট্রাইব্যুনালে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা আরো কষ্টকর।
ঢাকার আদালতের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী গণমাধ্যমকে বলেন, একটি মামলার আসামি হলেই তাকে দোষী বলা যাবে না। অনেকেই বিনা কারণে বা মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে আসামি হয়। এজলাস সংকটের কারণে তাদের এমন ভোগান্তি অমানবিক। জরুরি ভিত্তিতে একটি এজলাসের ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
ট্রাইব্যুনাল একাধিক হতে পারে
ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের প্রায় সব থানায়ই সাইবার অপরাধের মামলা আছে। বিচারপ্রার্থীদের একটি মাত্র ট্রাইব্যুনালে আসতে হয়। এ কারণে আসামি ছাড়াও বাদী ও সাক্ষীদেরও ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। এ অবস্থা দূর করতে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত বলে মনে করেন বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সাইবার ট্রাইব্যুনাল আরো গঠন করা হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় আছে। সরকার দেশে মামলাজট কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ কারণে আরো সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৬৮ ধারায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও সরকার একটি মাত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, যা আইনের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, ৬৮ ধারায়ই উল্লেখ রয়েছে, এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচারের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। একটি ট্রাইব্যুনালে সারা দেশের মামলার বিচার দ্রুত করা সম্ভব নয়। এ কারণে সরকারের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোতে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। তাহলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তিও কমবে, দ্রুত বিচারও সম্ভব হবে।
২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় আইনের ৬৮ ধারা অনুযায়ী। আইনে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা উল্লেখ আছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ