তিনটি পৃথক মামলায় আসামিদের জামিনে জালিয়াতির অভিযোগে আইনজীবী মো. জালাল উদ্দিনকে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালতে আগামী ছয় মাসের জন্য মামলা পরিচালনার ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এসব জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আজ সোমবার (২৮ মে) বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বলা হয়েছে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল জালিয়াতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
প্রসঙ্গত, আইনজীবী জালাল উদ্দিন পৃথক তিনটি মামলায় কখনও ‘জামাল উদ্দিন’ আবার কখনও ‘জালাল উদ্দিন’ নাম ব্যবহার করে মামলা পরিচালনা করতেন। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় তিনি ‘হারুন অর রশিদ’ নামে এক আইনজীবীর আইডি (আইনজীবী কার্ড) ব্যবহার করতেন।
ওই আইনজীবীর জালিয়াতির বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল। এরপর ওই আইনজীবীকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন সোমবার (২৮ মে)হাজির হলে আদালত এই আদেশ দেন।
এর আগে জামিন জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ায় গত ২৩ মে আসামির জামিন বাতিল করেন হাইকোর্ট। ওই মামলার আসামির বিরুদ্ধে একটি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ আছে।
ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশুটির বয়স ১০ বছর। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম বিল্লাল ভূঁইয়া। তাঁর বয়স ৪৫। হাইকোর্টে জামিন আবেদনের সময় বলা হয় মেয়ের বয়স ২১ বছর। তাঁর সঙ্গে বিল্লালের প্রেমের সম্পর্ক আছে!
গত ৯ মে হাইকোর্ট বিল্লাল ভূঁইয়ার জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু মামলার কাগজপত্র পরীক্ষার পর বেরিয়ে আসে তথ্য গোপন ও জালিয়াতির বিষয়। বাতিল করা হয়েছে বিল্লালের জামিন।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে মামলার তদবিরকারককে তলব করেছেন হাইকোর্ট।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল সাংবাদিকদের জানান, গাজীপুর সদরের রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মো. রবিউল ইসলামকে আবেদনে তদবিরকারক হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবেদনকারীর আইনজীবী হিসেবে দেখানো হয়েছে মো. জামাল উদ্দিনকে। কিন্তু জামালের যে আইনজীবী পরিচয়পত্র জমা দেওয়া হয়েছে সেখানে আইনজীবী হিসেবে নাম রয়েছে মো.হারুন-অর রশিদের। অথচ হারুন-অর রশিদ এ মামলায় শুনানি করেননি!
জাহিদ সরওয়ার কাজল জানান, হারুন-অর-রশিদের সনদের নম্বর ব্যবহার করেন জামাল উদ্দিন। তিনি আরো জানান, জামাল উদ্দিন হাইকোর্টের আইনজীবী নন। তিনি গাজীপুর জেলা জজ আদালতের আইনজীবী।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর শ্রীপুরে এক ১০ বছর বয়সি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। অভিযোগ উঠে বিদেশ ফেরত বিল্লাল ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি এ ঘটনার দায়ী। তাঁর স্ত্রী ও ছেলে বিদেশে থাকে। ধর্ষণের পর বিষয়টি প্রকাশ না করতে হুমকি দিয়ে ওই শিশুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তিনি। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে শিশুটি ঘটনাটি তার মাকে জানায়।
পরে শিশুর মা বিল্লাল ভূঁইয়া, রুবেল ভূঁইয়া (২২) ও হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়াকে (৪৫) আসামি করে মামলা করেন। পরে শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয়।
জাহিদ সরওয়ার কাজল বলেন, ‘শুরু থেকে বিল্লাল পলাতক ছিল। এর মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনে ধর্ষণের প্রমাণও মিলেছে। পরে ১৭ নভেম্বর এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এ মামলা এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে।’
জাহিদ সরওয়ার আরো জানান, এ অবস্থায় চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করেন বিল্লাল। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরবর্তী সময়ে ২৪ এপ্রিল জামিন আবেদন করেন বিল্লাল। ওই আবেদন খারিজ করে দেন গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ।
তবে ৯ মে হাইকোর্ট তাঁর জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। কারণ হাইকোর্টের ওই জামিন আবেদনে বলা হয়, মেয়েটির বয়স ২১ বছর। দুজন একে অপরকে ভালোবাসে। মেয়ের মা সেটি পছন্দ করেন না। ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেনি। কোনো প্রমাণ নেই মেডিকেল সনদে!
জাহিদ সরওয়ার কাজল বলেন, ‘জামিনের আদেশ নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর জালিয়াতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতে নজরে আসে। জালিয়াতির বিষয়টি পেয়ে আমাকে জানানো হয়। তাঁরা মেডিকেল সনদ, হাইকোর্টের আইনজীবীর নাম জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে। কিন্তু আসামি বিল্লাল এখনো বের হতে পারেনি। ও জেলেই আছে।’