সরকারি কৌঁসুলি হলেন সদালাপী রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী
অ্যাডভোকেট মো: রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

যেসব কাজ মাদক আইনে অপরাধ

মো: রায়হান ওয়াজেদ চৌধুরী:

মাদক বিষধর সাপের বিষাক্ত দংশনের মতো নিঃশেষ করে দিচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রকে। সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধির মতো মাদকাসক্তি ব্যক্তিকে ধ্বংস করার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে প্রতিনিয়ত। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্রমশ নীতিহীন, দায়হীন, ভিত্তিহীন ও দুর্বল হয়ে অন্ধকার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিস্তর ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যার ফলে দেশে বাড়ছে নানা মাত্রার অপরাধ। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসহ সকল অনৈতিক অত্যাচার অনাচারের পেছনে মাদকের অশুভ কালো হাত। সারাদেশে প্রতিবছর যত সামাজিক অপরাধ হয়, তার ৮০ শতাংশের কারণ হচ্ছে মাদক। যার কারনে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মাদক বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো-১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯৯ সালের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০১ সালের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড বিধিমালা, ২০০২ সালের এলকোহোল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ও ২০০৫ সালের বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাশক্তি পরামর্শকেন্দ্র, মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুর্নবাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিধিমালা ইত্যাদি।

মাদক বিরোধী এতগুলো সুস্পষ্ট আইন থাকার পরও কমেনি মাদকদ্রব্যের ব্যবহার, পাচার ও জড়িত নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ড। সরকার বিভিন্ন সময়ে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা ও সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করলেও দেশকে মাদকমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। মূলত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেশকে মাদকমুক্ত করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। আর এই কাজে সহযোগীতা করে যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কার্যত মাদক নির্মূলের জন্য দেশের সকল স্তরের নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সোচ্চার অবস্থান প্রয়োজন। সবাই যদি মাদকের কুফল সম্পর্কে জানে এবং অপরাধে আইনের কঠোর শাস্তি সম্পর্কে অবগত হয় তাহলে দেশকে পুরোপুরি মাদক নির্মূল করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং অপরাধ কমবে। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে মাদক কি? মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন, ২০০৪ এ মাদকের সুস্পষ্ট কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। তবে ১৯ ধারায় বেশকিছু মাদক দ্রব্যের নাম ও আইন লঙ্ঘনে শাস্তি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় তফসিলে বিভিন্ন শ্রেণীর মাদকদ্রব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। মাদক দ্রব্য হলো একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে । সহজ কথায় নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে কোন মাধ্যম। বিভিন্ন ধরণের মাদক দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হিরোইন, কোকেন, প্যাথিডিন, মরফিন, ইয়াবা, আফিম, ক্যানাবিস, মারিজুয়ানা, গাজা, ফেনসিডিল, বিয়ার , কেটামিন, স্পিড, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতা লাগানোর আঠা পর্যন্ত। এই ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী যে কোন প্রকারের মাদক দ্রবের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কোন কার্য মাদক আইনে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে সেটা ১৯৯৯ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯ ধারায় স্পষ্টত বলা হয়েছে।

উক্ত আইনের ৯ ধারার বিধান মতে , বাংলাদেশে সরকারের লাইসেন্স ব্যতীত কোন মাদকদ্রব্য বিক্রি করা যাবে না এবং এ্যালকোহল ০.৫% অধিক ছাড়া সকল প্রকার মাদকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকান্ড কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উক্ত আইনে আরো বলা হয়েছে কোনো প্রকার মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ করা ,উৎপাদন করা, প্রক্রিয়াজাতকরণও অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। এছাড়াও সব ধরনের মাদকদ্রব্যে বহন করা, পরিবহন করা, আমদানী করা, রপ্তানী করা, সরবরাহ করাও অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। আরোও বলা হয়েছে কোন প্রকার মাদকদ্রব্যের সংরক্ষণ করা গুদামজাতকরণ করা, ধারণ, প্রদর্শন করা, ক্রয় করা, বিক্রয় করা, প্রয়োগ করা ও ব্যবহার করাসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকাণ্ডই এই আইনে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ করাকে অপরাধ ; উক্ত আইনে আরো বলা হয়েছে , কোন প্রকার মাদকদ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানী, রপ্তানী, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয় বা এসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরাধ। শুধু তাই নয়, মাদকদ্রব্যে সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকান্ডে অর্থ বিনিয়োগ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরিচালনা বা এর পৃষ্ঠপোষকতা করাও অপরাধ।

আইনে আরো আছে, কোনো মাদকদ্রব্যের উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এমন কোন ধরনের কোনো দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানী, রপ্তানী, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার করাও অপরাধ। এক কথায় বলতে গেলে, মাদকের সাথে কোনভাবে সংশ্লিষ্টতা আছে ঐ সকল কর্মকান্ড মাদক আইনে অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন, ২০০৪ এর ১৯ ধারায়। মাদক দ্রব্যের পরিমান বেধে সর্বোচ্ছ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ৩৫ক ধারার বিধান মোতাবেক দন্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত হতে পারে। ৩৬ ধারার ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ব্যতিরেখে এই আইনের অধীন সংগঠিত কোন অপরাধ স্থানে যে কোন সময়ে তল্লাশি করতে পারে। প্রয়োজনে আইনের অধীন কোন অপরাধ তদন্ত বা তল্লাশী সময়ে ৩৭ ধারার ক্ষমতাবলে দেহ তল্লাশী করা বা এক্সরে সহ যেকোন পরীক্ষা করতে পারবে। ৪১ ধারার বিধানমতে প্রকাশ্য স্থানে বা কোন চলমান যানবাহনে তল্লাশী করে মাদকদ্রব্য বা দলিল-দস্তাবেজ আটক করতে পারে এবং যার কাছে পাওয়া যাবে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। মূলত ৯ ধারার সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই ক্রমই বেড়ে চলছে মাদকের ব্যবহার, বাণিজ্য ও পাচারসহ সংশ্লিষ্ট নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ড।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এখনই সময় মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট সব রকম অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতা জরুরি।

লেখক: শিক্ষানবীশ আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট। ইমেইল – ll.braihan@gmail.com