সিরাজ প্রামাণিক:
শুরুতেই জেনে নেয়া যাক, ময়না তদন্ত কি? কোনও ব্যক্তি কখন, কিভাবে, কোথায়, কিসের দ্বারা মৃত্যু বরণ করেছে বা তার মৃত্যু কি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক এই সকল তথ্য জানার জন্য মৃতদেহকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক যে বিশেষ পরীক্ষা করা হয় তাকে পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত বলে । দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। লজ্জা নারীর ভূষণ। অথচ এই নারীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন কারণে মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগের লাশের ময়না তদন্ত করছেন পুরুষ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এর মূল কারণ নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মারাত্মক সংকট। এমনকি ধর্ষিত নারীর সুরতহাল রিপোর্ট করছেন পুরুষ ডাক্তার। আর কখনো সাথে থাকেন পুরুষ পুলিশ অফিসারও। অথচ অনেক আগেই নারী পুলিশ এবং নারী ডাক্তার দিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট করতে আমাদের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন।
আইনের ভাষায়, নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে অপরাধ প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূূর্ণ ও কার্যকর প্রমাণ হিসেবে ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্রকে বিবেচনা করা হয়। সনাক্তকৃত আলামত অভিযুক্তের কি-না তা প্রমাণ করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন প্রতিকারে মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক নয়। আইন বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার জন্যই নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে অপরাধীরা উৎসাহিত বোধ করে।
শুধু নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞই নন, নেই নারী ডোমও। তাই নারী চিকিৎসক নারীদের লাশের ময়না তদন্ত করলেও লাশ কাটাছেঁড়া করতে তাকে সহায়তা করছেন ওই পুরুষ ডোমই। কাজেই নারীর গোপনীয়তা আর কোনোভাবেই রক্ষা হচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে থাকলে অন্তত নারীদের ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা তো আর পুরুষ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের হাতে দিতে হতো না।
পারিবারিক নির্যাতন, সহিংসতা, ধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন হয়রানিসহ নারী ভিকটিমদের সাপোর্ট দিতে নারী পুলিশ কর্মকর্তা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার সাথে নারী ভিকটিমরা সব বিষয় খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন না। এ ছাড়া কোনো নারী খুন হলে তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তাকে সমস্যায় পড়তে হয়। ধর্ষণ, হত্যা, দুর্ঘটনার মামলা অথবা ছেলে বা মেয়ের বয়স নির্ধারণে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে সনদ নিতে হয়। আইনের চোখে এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অনেকে মনে করেন, এ দলিল পেতে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হন নারী। অবাক করার বিষয় যে, দেশের কোনো হাসপাতালেই নারীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য পৃথক কক্ষ নেই। চিকিৎসকদের বসার কক্ষে পুরুষ চিকিৎসক পুরুষ ওয়ার্ডবয়ের সহযোগিতায় সেই টেবিলের ওপর ধর্ষণের শিকার নারীকে রেখে তার পরিধেয় কাপড় খুলে শারীরিক পরীক্ষা করেন।
ময়না তদন্তের নিয়ম সাধারণের কাজে ভয়ংকর মনে হতে পারে। যে স্থান বা গৃহে ময়না তদন্ত করা হয় সেই গৃহকে প্রচলিত ভাবে ‘লাশ কাটা ঘর’ বলে। প্রথমে মৃতদেহকে এই লাশকাটা ঘরে নিয়ে আসা হয়। এরপর যে ডাক্তার লাশ ময়না তদন্ত করবেন তিনি ময়না তদন্তের প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রাদি পরীক্ষা করেন এরপর তিনি সুরতহাল রিপোর্ট পরীক্ষা করেন। ময়না তদন্তের প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রাদির মধ্যে থাকে সুরতহাল রিপোর্ট, সংশ্লিষ্ট থানার চালান, নির্ধারিত ময়না তদন্ত রিপোর্ট ফরম ইত্যাদি। কাগজ পত্রাদি পরীক্ষা করার পর ডাক্তার বাহ্যিক ভাবে মৃতদেহকে পরীক্ষা করেন। বাহ্যিক পরীক্ষা শেষ করার পরই শুরু করা হয় আসল কাজ। এ পর্যায়ে মৃতদেহকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়। মৃতদেহ যিনি ব্যবচ্ছেদ করেন তাকে ‘ডোম’ বলা হয়ে থাকে। ব্যবচ্ছেদ করার সময় মৃত দেহের গলা থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলা হয় এবং মাথার করোটি খুলে ফেলা হয়। মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করার পর তার অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো যেমন স্টমাক, কিডনি, হার্ট, লাঞ্চ, লিভার, ব্রেইন ইত্যাদি বের করে লবণ পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর এই অঙ্গগুলো ডাক্তারি পরীক্ষা শেষে পুনরায় মৃতদেহের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয় এবং পরিশেষে মৃতদেহের শরীর সেলাই করে দেয়া হয়।
কোনও মানুষের অপমৃত্যু হলেই তাকে দাফনের আগে তার পোস্টমর্টেম করা হয়। দেহের যে কোনও অঙ্গের পোস্টমর্টেম হতে পারে। এমনকি থেঁতলানো বা মণ্ডে পরিণত দেহাবশেষের, নরকঙ্কাল, একটি একক হাড়, দেহ বিচ্যুত যে কোনও অঙ্গ, এমনকি একটি আঙুলেরও ময়নাতদন্ত হতে পারে। লাশ পচা বা-গলিত হলেও তার পোস্টমর্টেম হতে পারে। ময়না তদন্ত কাজে সরকারের চারটি বিভাগ সম্মিলিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফরেনসিক চিকিৎসা বিভাগ, আইনজীবীগণ তথা আইন মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ এবং সর্বোপরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ বিভাগকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকতে হয় ময়নাতদন্ত কার্যে।
পোস্টমর্টেম বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পোস্টমর্টেমের ভুলের কারণে একজন নিরপরাধ লোকের শাস্তি হতে পারে, আবার একজন অপরাধী ছাড়াও পেতে পারে। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে এই রিপোর্ট তৈরি এবং আদালতে উপস্থাপন করা হয়। যে ডাক্তার মৃতদেহের ময়না তদন্ত করে থাকেন তাকে মামলা চলার সময় আদালতে ময়না তদন্ত সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দিতে হয়।
সূত্র জানায়, সারাদেশে ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজে বড়জোর ৩০ জন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। তার মধ্যে নারী আছে মাত্র ৪ জন। অথচ প্রয়োজন কমপক্ষে ১৫০জন। প্রায় ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে একজন করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও সেসব মেডিকেল কলেজ ব্যক্তি মালিকানায় হওয়ায় ময়না তদন্ত ও ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা করার নিয়ম নেই। গাইনি এবং অন্যান্য ক্লিনিকেল বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকলেও ফরেনসিক মেডিসিনে নারী ও পুরুষদের আগ্রহ কম। অনাগ্রহের মূল কারণ এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পর প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ কম। মরা মানুষের চিকিৎসক মনে করে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী আসতে চায় না। মনে করে এরা তো মরা মানুষের ডাক্তার, তাই মরলে তাদের কাছে যাবনে। তাছাড়া অন্যদেশে প্রতিটি ময়না তদন্তের জন্য আলাদা প্রণোদনা বা ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে সেই সুবিধা নেই।
এদিকে ফরেনসিক মেডিসিনের বিশেষজ্ঞদের ২৪ ঘণ্টাই দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং ময়না তদন্তের পর নিজের রিপোর্টের সপক্ষে আদালতে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যাও দিতে হচ্ছে। তখন ময়না তদন্তের রিপোর্ট যাদের বিরুদ্ধে যায় তাদের হাতে লাঞ্চিত হওয়ারও শঙ্কা থাকে। কোনো নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। এত ঝামেলার পর নারী তো বটেই, পুরুষ চিকিৎসকরাও ফরেনসিক বিষয়ে জীবন গড়তে চান না।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘নারীর দেহে ময়না তদন্তে নারী চিকিৎসক।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: 01716-856728