দিনে টানা ১৪ ঘণ্টা কাজ। কখনো এর চেয়েও বেশি। অফিসে পদস্থ কর্মকর্তাকে খুশি করা চাই। বাড়ির কাজ সুনিপুণ হতে ‘শত হাতে’ কাজ করা চাই। পরীক্ষায় ভালো করতে বেশি বেশি পড়া চাই। এমন মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে করতে কেউ হাঁপিয়ে ওঠেন। কেউ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেউ উপায় খোঁজেন একটু দম ফেলার।
সেই উপায় খুঁজতে গিয়ে এমন কাজে ডুবে থাকা বা থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষেরা অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে ‘জেলে’ ঢুকছেন। কথাটা শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এমন ঘটনাই ঘটছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে কয়েদিদের মতো থাকার জন্য আলাদা কক্ষ আছে। সেই কক্ষ থাকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। আলাদা ইউনিফর্ম আছে। ফোনও নেওয়া যায় না। জেনে শুনে এমন যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে সেই ‘কারাগারে’ ঢুকছেন অনেকে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্ম আসক্ত মানুষদের জন্য দেশটির রাজধানী সিউল থেকে দুই ঘণ্টা দূরত্বে পাহাড়ি এলাকা হোংচিউনে কারাগারের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে অবসাদ ও দুশ্চিন্তা মুক্তি কেন্দ্র ‘প্রিজন ইনসাইড মি’। ২০০৮ সালে এটা চালু হওয়ার পর দেশটির বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মানুষ সেখানে থেকেছেন। এর মধ্যে অফিস কর্মী, গৃহবধূ, কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছেন। ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রও সেখানে থেকেছিল।
সেখানে প্রতিটি কক্ষে একটি করে জানালা আছে। কক্ষের মেঝে কাঠের। একটি ছোট টেবিল আছে। তাতে একটি ডায়েরি, চা খাওয়ার সরঞ্জাম, যোগ ব্যায়ামের ম্যাট রয়েছে। কেউ আতঙ্ক বোধ করলে বা কোনো প্রয়োজনে সাহায্যের দরকার হলে বেল দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। দরজা বাইরে থেকে সব সময় বন্ধ থাকলেও ভেতর থেকে কীভাবে খোলা যায় তা শিখিয়ে দেওয়া হয়।
তবে এমন এক ‘জেলখানা’ খোলার কারণ কী? জানা যাক সেই তথ্য।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় কেওয়ান ইয়ং-সুক নামে এক আইনজীবী প্রচণ্ড কাজের চাপে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। ছয় মাস তিনি প্রতি সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে যান। তাঁর অবস্থা এমন হয়েছিল প্রায় প্রতিদিন তাঁর মনে হতো তিনি আসলে মুক্ত জীবনে নেই। তিনি কারাগারে বন্দী অবস্থায় আছেন। হয়তো কারাগারের জীবনও তাঁর এ অবস্থা থেকে ভালো।
তাঁর এক বন্ধু ছিলেন কারারক্ষী। সেই বন্ধুকে এ কথা জানাতেই তিনি জানান, সত্যিকারের জেলে এসে কিছুদিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে থাকার জন্য অনুমতি নিতে নানা হ্যাপা সামলাতে হবে। সেখান থেকেই কেওয়ানের ভাবনা আসে জেলের মতো একটা কিছু তৈরি করা যেখানে কাজের চাপে অতিষ্ঠ লোকজন শান্তি খুঁজে পাবেন, অবসাদ থেকে মুক্ত হতে পারবেন।
২০০৮ সালে এই ‘জেলখানা’ খোলার পর সেখানে দুদণ্ড শান্তি খুঁজতে এসেছেন অনেকে। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ২০ ঘণ্টা একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। কেউ ফোনও ব্যবহার করতে পারেন না।
কানাডার সিবিসি নিউজে বলা হয়েছে, অটোপার্টস প্রকৌশলী সুক-ওয়ান ক্যাং (৫৭) অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে এই ‘কারাগারে’ ছিলেন। সেখানে ২৮টি কক্ষ রয়েছে। একেটি রুমের আয়তন পাঁচ মিটার বা প্রায় ৫৪ বর্গফুট। সুক-ওয়ান যে কক্ষে থাকতেন তার নম্বর ছিল ২০৭। কক্ষে প্রবেশের আগে তিনি ফোন জমা দিয়ে দেন। নির্দিষ্ট পোশাক গাঢ় নীল শার্ট ও ঢিলা পায়জামা গায়ে থাকতেন। কক্ষের মেঝেতেই ঘুমিয়েছেন। কক্ষের দরজার নিচ দিয়ে তাঁকে খাবার দেওয়া হতো। কক্ষের ভেতরে একটি কর্নারে ছিল টয়লেট।
৩৫টি দেশের অর্থনৈতিক সহায়তা ও উন্নয়ন সংগঠনের (ওইসিডি) তথ্য অনুসারে, এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার লোকজন সবচেয়ে বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে দেশটির অবস্থান দ্বিতীয়। মেক্সিকোর পরই দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান। দেশটির লোকজন বছরে ২ হাজার ৬৯ কর্মঘণ্টা কাজ করেন। যেখানে ওইসিডিভুক্ত অন্য দেশগুলোতে বছরে গড়ে ১ হাজার ৭৬৪ কর্মঘণ্টা কাজ করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করা এবং দিনে ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অবসাদমুক্তি কেন্দ্রে থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রকৌশলী ক্যাং জানান, তিনি সিউলে কিয়া ও হুন্দাই গাড়ি তৈরির কারখানায় সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করেছেন। অতিরিক্ত কাজের চাপের ক্লান্তি থেকে মুক্ত হতে ‘প্রিজন ইনসাইড মি’তে ছিলেন। তিনি যখন সেখানে ছিলেন, তখন সেখানে তাঁর মতো আরও ১৪ জন ছিলেন। তিনি সাত দিন ছিলেন। এর জন্য তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে কোরীয় মুদ্রায় ৫০ লাখ ওয়ান (প্রায় ৩৭ হাজার টাকা)। সাত দিন পর তিনি খুব ফুরফুরে লাগছিল তাঁর। বললেন, ‘আমি খুব তরতাজা বোধ করছিলাম। মনটা হালকা লাগছিল।’ এ নিয়ে তিনি তিনবার সেখানে থেকেছেন বলে জানান।
বাইরের দুনিয়া থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকে সেখানে ক্যাংয়ের মতো নিজেকে উপলব্ধি করতে পারেন। অনেকে কক্ষে একাকী হওয়ার পর আবেগে কান্নাকাটি করেন। তাঁরা একধরনের স্বাধীনতা বোধ করেন।
‘প্রিজন ইনসাইড মি’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জি-হিয়াং নোহ (প্রতিষ্ঠাতা আইনজীবী কেওয়ান ইয়ং-সুকের স্ত্রী) বলেন, ‘এখানে একাকী বন্দী রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য এটা কারাগার নয়। আসল কারাগার হচ্ছে এর বাইরের দুনিয়া।’
দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত কাজ এখন একটি উদ্বেগের বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিউলের খ্যাতনামা শ্রম আইনজীবী বংসু জাংয়ের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় বয়স ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব অতিরিক্ত কাজ করার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, ‘এখানে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও পদস্থ কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি রয়েছে। কর্মীরা তাঁর বসের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে চান। তাই তাঁরা বস যা বলেন তা অবশ্যই মেনে চলার চেষ্টা করেন।’
কয়েক দশক আগেও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কঠোর পরিশ্রম করাকে জরুরি বলে ধরা হতো দেশটিতে। সেটাই এখন রীতিমতো উৎপাতে পরিণত হয়েছে। সন্তান জন্ম দেওয়ার হার কমে যাওয়া এবং উদ্বেগজনকভাবে আত্মহত্যার হার বাড়ার মতো সামাজিক ব্যাধির জন্য এই অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতাকে দায়ী করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের বিষয়টি এতটাই উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে দেশটির প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন ‘বিশ্রাম নেওয়া অধিকার’ শীর্ষক প্রচারাভিযান শুরু করেছেন গত বছর থেকে। এই প্রচারাভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে, সপ্তাহে সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা ৬৮ ঘণ্টা থেকে ৫২ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা। চূড়ান্ত আইনে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টার সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি এবং ওভারটাইমের ব্যাপারটি কীভাবে থাকবে, তা নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে দর-কষাকষি ও বিতর্ক চলছে।
‘প্রিজন ইনসাইড মি’-এর প্রতিষ্ঠাতা কেওয়ান ইয়ং-সুক বলেন, ‘আমি ভাবতাম, আমি যদি সঙ্গী ছাড়া একা বন্দী থাকতে পারতাম, তাহলে ভালো থাকতাম। অন্তত সেখানে কোনো মানুষ থাকত না, আমার খোঁজের জন্য ফোনগুলো বেজে চলত না, ধূমপান বা মদ্যপান থাকত না। এমন এক কারাগারেই হয়তো শান্তি খুঁজে পেতাম।’
এমন এক কারাগারে যেতে না পারায় নিজের ভাবনা থেকেই কারাগারের আদলে তৈরি করেছেন ‘প্রিজন ইনসাইড মি’। হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরি নামে একটি অলাভজনক সংস্থা এটি পরিচালনা করছে। এটা তৈরিতে ব্যয় হয়েছে তিন বিলিয়ন ওয়ান (প্রায় ২২ কোটি ৪১ লাখ টাকা)। ব্যয়ের বেশির ভাগই নিজস্ব অর্থায়ন। বাকিটা এসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থসহায়তা থেকে। প্রথম আলো