প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সবার অনুভূতি একইরকম-বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
তালাকের পর দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা এক মায়ের আবেদনের রুল শুনানিতে আজ বুধবার (০৪ জুলাই) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।
একইসঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়ার পরও সন্তানদের কথা বিবেচনা করে বাবা-মা আবার এক হতে চান কিনা এবং এ ব্যাপারে কী কী অগ্রগতি হয়েছে সে বিষয়ে জানাতে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন আদালত।
২০০২ সালে রাজশাহীর মেয়ে কামরুন্নাহার মল্লিকা এবং মাগুরার ছেলে মেহেদী হাসান বিয়ে করেন। মল্লিকা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা আর মেহেদী বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। তারা দুই সন্তানের বাবা-মা।
তবে এক পর্যায়ে এসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। গত বছরের মে মাসে নোটিশের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেন তারা। তবে এর কিছুদিন আগে দুই সন্তানকে মাগুরায় গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন মেহেদী। বড় ছেলের বয়স এখন ১২ আর ছোট ছেলের ৯ বছর।
বোনের তত্ত্বাবধানে মাগুরা জেলা শহরের একটি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেন মেহেদী। এর মধ্যে দুই সন্তানের দেখা পাননি মা মল্লিকা। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজ হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন মল্লিকা।
এ আবেদনের পর গত ২৯ মে শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও বাবা মেহেদীকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়।
২৫ জুন হাজিরের হলে দীর্ঘদিন পর মুখোমুখি হওয়ায় সন্তান ও মায়ের কান্নায় এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিচারপতি, আইনজীবী ও উপস্থিত সাংবাদিকদেরও চোখে জল নেমে আসে। এক পর্যায়ে আদালতের জিজ্ঞাসার জবাবে বড় ছেলে বললেন-‘আমরা আর কিছু চাই না। বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই।’
বড় ছেলের এমন বক্তব্যের পর বাবা-মাকে নিয়ে খাস কামরায় কথা বলেন আদালত। পরে আদেশে আদালত বলেন, আপাতত শিশু সন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে পিতা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবেন। পরে আদালত ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন।
আদালতে মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। আর মল্লিকার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস ও এ কে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।
আজ ৪ জুলাই বুধবার আদালত বলেন, পরিস্থিতির কি কোনো উন্নতি হয়েছে?
তখন তাপস কান্তি বলেন, হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটি তার বাবাকে মায়ের বাসায় রাতে থেকে যাওয়ার আবদার জানালে বাবা রাজি হলেও মা রাজি হননি। রাত একটায় বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পারিবারিক সমস্যার কারণে ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ার কারণে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে বাবার চাকরি চলে যায়।
পারিবারিক এই বিষয়টি স্মরণ করে দিয়ে এ সময় আদালত বলেন, এ ঘটনায় মিডিয়ায় কিভাবে গিয়েছে দেখেছেন? জনমত সেটাকে কিভাবে দেখেছেন। এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তখন তাপস কান্তি বলেন, বাবা শিশুদের কাছে সারেন্ডার করেছে। বাচ্চারা যেভোবে চাইবেন বাবা সেভাবে করবেন।
আদালত বলেন, এটাকে কি পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?
তাপস কান্তি বলেন, কিছু তো উন্নতি হয়েছে।
পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। সুতরাং দুই জনের মধ্যেই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য আরো সময় লাগবে।
তখন আদালত বলেন, ঠিক। এটাতো রাতারাতি উন্নতি হবে না।
রুহুল কুদ্দুস বলেন, বাচ্চা দুটি ইতিমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চারা খুশি প্রতিদিন মা স্কুলে আনা নেওয়া করছেন।
এ সময় আদালত বলেন, ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হয় না।
তখন রুহুল কুদ্দুস বলেন, এই ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর যেখানে গিয়েছে সেখানে বলেছে তোমরা পূন্যের কাজ করেছো। আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চাশা বেড়ে গেছে। কোর্ট সমঝোতার জন্য সময় দিয়েছে। এটা সর্বমহলে বার্তা দিয়েছে। শিশুদের কল্যাণ বিবেচনায় পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে।
তিনি আরও বলেন, তবে উভয়পক্ষকে মনে রাখতে হবে, আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্য কিছু ভেবে থাকেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে আদালতের হাত খাটো না। বাচ্চাদের মঙ্গল চিন্তা করে আদালত যে কোনো আদেশ দিতে পারেন।
তখন আদালত বলেন, শুধু এ বিষয়না, প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সবাইর অনুভূতি একই রকম। হয়তো এ দুটি বাচ্চা আজকে আমাদের সাথে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। সারা দেশের ডিভোর্স দম্পতির সব বাচ্চারই অনুভূতি এক, তারা সেটা বলতে পারেনা। এ বাবা মা শুনলেও অন্যরা বাচ্চাদের অনুভূতি কানে নিচ্ছে না।
এ সময় তাপস কান্তি বলেন, বাচ্চারা যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকায় অনুমতি দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ড্রয়িং রুমে থাকবে।
তখন আদালত বলেন, অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর আদালত শিশু ও বাবা-মা দুজনের কথা শোনেন।
আদালত শিশুদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, তোমরা কে কোন দল সমর্থন করো। জবাবে বড় শিশু বলে, ব্রাজিল। ছোটটি বলে-আমি আর্জেন্টিনা।
বাবা-মাকে উদ্দেশ্যে করে আদালত বলেন, আপনারা দুইজনই শিক্ষিত সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।
তখন তাপস কান্তি বলেন, মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরছে। বাবারও ইচ্ছা শিশুদের নিয়ে ঘুরতে।
আদালত বলেন, বাবাও ঘুরতে পারবেন। এরপর আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ঠিক করেন। এ সময় আদালত বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতির জন্য দুই পক্ষই সময় চেয়েছেন। সময় দেওয়া হলো।
আদেশের পরে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আজকে আদালতে বাবা-মাসহ বাচ্চা দুটি উপস্থিত ছিলেন। আদালত আমাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন ওনাদের দুজনের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কত দূর। আমরা বলেছি যে, আর একটু সময় যদি আপনারা দেন। তাহলে আমি সন্তানের মায়ের পক্ষ থেকে বলেছি, মা ওপেন আছেন। বাবার পক্ষ থেকে তার আইনজীবীও বলেছেন, সন্তানের ভালোর জন্য তিনি মেনে নেবেন। আমাদের এ বক্তব্য আদালত শুনে আগামী ১ আগস্ট তারিখ রেখেছেন।