দেশের নানা পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করলো নতুন সংগঠন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। শনিবার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রার ঘোষণা দেয়া হয়।
সংগঠনের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন ডা. নুজহাত চৌধুরী। সভায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তার আজন্ম লক্ষ্য ধর্ম নিরপেক্ষতা টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মানুষের মধ্যে বিভাজনের উপাদান তিনটি- ধর্ম, রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বার্থ। সেই বিভাজন দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল বায়বীয় বাচনিক উচ্চারণের মাধ্যমে নয়, সক্রিয় কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশ চলতে পারে না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, রাষ্ট্র ধর্ম পালনে বাধা দেবে না এবং ধর্ম পালনে উৎসাহিতও করবে না। গণতান্ত্রিক দেশে এসব শর্ত মানতে হবে।’
পুঁজিবাদী কাঠামোর কারণে এসব শর্ত থেকে ‘বাংলাদেশ অনেক দূরে সরে আছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অসুস্থ সমাজে বাস করছি আমরা। হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, শিশুধর্ষণ হচ্ছে- যেটা পাকিস্তানি হানাদাররাও করেনি। প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। এই অসুখের নাম পুঁজিবাদ।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন,‘বারবার ক্ষমতা পরিবর্তন হয়, আর আঘাত গিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু মানুষদের উপরে। সে জন্য মানুষের মধ্যে ঐক্য তৈরি করা জরুরি। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হলে সম্প্রীতি রক্ষা করবে না। ব্যক্তিস্বার্থ সব সময় সম্প্রীতিকে নষ্ট করে। সাম্যতা নেই। সমতার কথাও যদি বলি, আমাদেরকে মানুষের মধ্যে বিভেদ দূর করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে হত্যা করা হয়েছে, আধুনিকতাকে হত্যা করা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতাকে হত্যা করা হয়েছে। সে কারণে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদেরকে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার জন্য কেবল সংগঠন গড়ে তুলে নয়, নাগরিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।’
বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা শুদ্ধানন্দ মহাথেরো বলেন, ‘আমরা বাঙালি। বাঙালিরা যদি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মিলে একসাথে কাজ করতে পারি তাহলে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। কারণ আমরা তো এক ভাষায় কথা বলি। সাম্প্রায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারলে বাঙালিত্বও ফিরে আসবে।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মো. আফজাল বলেন, ‘মদিনা সনদ সব ধর্মের সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত; আর তার প্রতিফলন ঘটেছে বাহাত্তরের সংবিধানে। সব ধর্মের মানুষের অধিকার সেখানে সমুন্নত রাখা হয়েছে।’
সম্প্রীতি বাংলাদেশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘খণ্ড খণ্ডভাবে প্রকাশের চেয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক শক্তির যে উত্থান, তাতে তরুণ প্রজন্ম কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত হবে। তাদেরকে সেই বিভ্রান্তি থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে দূরে সরিয়ে আনতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি মাহফুজা খানম, রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী গুরু সেবানন্দ, খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, সাংবাদিক আবেদ খান, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব সাংবাদিক হারুন হাবীব, ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, ইসকনের প্রতিনিধি সুখীল দাস ও সংগঠনের সদস্য সচিব মামুন আল মাহতাব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সূচনা হওয়া অনুষ্ঠানে অতিথিদের পাশাপাশি শিক্ষার্থী, ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ ছিল জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন।