মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান:
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ একটি রুল শুনানীতে গতকাল বলেছিলেন চিকিৎসা সেবা কিছু দুর্বৃত্তের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে কিন্তু কসাই সম্বোধন করলেন না কেন কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
সারাটা জীবন আমরা হুজুর দেখতে পারিনা, হুজুর দেখলে সবাই কেমন যেন আঁড় চোখে তাকাই। অথচ জন্ম কিংবা মৃত্যু হলে আমাদের আবার হুজুর ছাড়া চলে না। বলা হয়-হুজুর জানাজাটা পড়িয়ে দিন কিংবা একটু দোয়া কালাম পড়ে মোনাজাত করে দিন!
এদিকে ‘উকিলসাব খালি মিথ্যা কথা কয়’ এমন বাচ্য মুখে তুলে তুলে আমরা মুখ আর ঠোঁটের কোনায় কোনায় ফেনা বের করে ফেলি অথচ আইনী জটিলতায় পড়লেই উকিলসাহেবের পেছনে ঘুরে ঘুরে জীবন যৌবন পার করে দেই। তখন আবার বলা হয় উকিলসাহেবের মতন মানুষই হয় না, তিনি না থাকলে আমার কিংবা আমার সম্পত্তির যে কি হতো!
পুলিশ ঘুষ খায়, চাঁদাবাজি করে মানুষকে নাজেহাল করে কত্ত অভিযোগ। অথচ আমরা এটাও দেখতে পাই পুলিশ অপরাধ নির্মূলের জন্য কিংবা দেশপ্রেম আর মানবতার জন্য নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দেয়।
আমি সুস্থ, পরিবারের সবাই দিব্যি চলছে কোন সমস্যা নাই, তাই এখন ডাক্তারসাব সবগুলা এক একটা কসাই। দূর! এরা মানুষ না, এরা মনে হয় কীট কিংবা জানোয়ার। এরা নাকি শুধু বলে ‘একটা একটা রোগী ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।’ অথচ আমার কিংবা আমার প্রিয়তম মানুষটি যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে ঠিক তখন কসাইয়ের কাছে টলমল চোখে এমনকি সৃষ্টিকর্তার নাম ভুলে আরজ করছি- ডাক্তারসাব-ডাক্তারসাব আমাকে বা আমার প্রিয়জনকে বাঁচান! আর এমন চোখের পানি দেখে অমনি ডাক্তার সাবের দিগ্বিদিক ছুটোছুটিতে নার্স-ইন্টার্ন ডাক্তার সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এই হল কসাই এর নমুনা।
এতক্ষন যা যা বলেছি তা পুরো প্রজাতির কথা বলেছি। হাইকোর্ট এর রুল প্রসঙ্গে বলেছি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কসাই শব্দটি ব্যবহার করতে পারেনি। কারণ বিজ্ঞ আদালত অনিয়মের মাঝেও মানবিকতার গন্ধ পেয়েছিলেন, আদালত জানেন কতশত ডাক্তার রোগীর শুশ্রূষা করার জন্য নির্ঘুম রাত কাটান, অকাতরে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো বিলিয়ে দেন। বিজ্ঞ আদালত এটাও জানেন বাংলাদেশে প্রতি ২০৩৯ জনের জন্য মাত্র একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছেন।
যখন আমরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস শেষে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়াই তখনো দেখেছি মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীদের হয় গ্রুপ স্টাডি না হয় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রোগীর বেডে বেডে ঘুরে বেড়ায়। মেডিকেলের লেখা পড়া কতটা কঠিন আর সময়সাপেক্ষ তা আমার খুব কাছের কিছু মানুষকে দেখে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমার আপনার বিবেকের কাছে প্রশ্ন-নির্বিচারে সকল ডাক্তারকে কসাই বলে সম্বোধন করা কি উচিত? এরপরও কি অসুস্থ হলে নির্লজ্জের মত কসাইয়ের কাছে যাব?
তবে এটা সত্য যে ভাল-মন্দ মিলিয়ে এই সৃষ্টি জগতের সবকিছু। তাই আলোর বিপরীতে আঁধারও দেখতে পাই আমরা। মহামান্য হাইকোর্ট বলেছে এই পেশা অনেকটা দূর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে। তাই এবার আসি চিকিৎসাপেশায় কি পরিমান অরাজকতা চলছে এই বাংলাদেশে সেই প্রসঙ্গে। কিছু ডাক্তার আছেন যারা রোগীর সাথে একটু সুন্দর করে কথাও বলেন না যার ফলে মাত্র ২/৩ মিনিটে বের হয়ে যেতে হয় চেম্বার থেকে তবে ফি মাত্র ৭০০-১০০০টাকা। অথচ ডাক্তারের একটা সুন্দর কথায় রোগী মানুসিকভাবে ৫০% ভালো হয়ে যেতে পারে। ডাক্তারের ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সারাদেশে চলছে অরাজকতা। আবার কতিপয় পয়সা লোভী ডাক্তার আছেন যারা চিকিৎসাসেবার নামে ব্যবসা কেন্দ্র খুলে বসেছেন, যাদের লালসার শিকার হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগন। সরকারী হাসপাতালের কিছু ডাক্তার আছেন যারা প্রাইভেট হাসপাতাল ও প্রাইভেট চেম্বারের দিকে নজর বেশি রাখেন, কারণ সেখানে টাকা ওড়ে শুধু ধরে নিতে হয়।
আমার জানামতে MBBS ও BDS শেষ করে BMDC এর সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ নামের আগে “ডাক্তার” শব্দ ব্যবহার করতে পারবেন না। অথচ হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে যদু-মধু, রাম-সাম সবাই সুযোগ পেলেই নামের আগে ‘ডাক্তার’ শব্দ জুড়ে দিচ্ছে। আমার ধারণা এমন নামমাত্র ডাক্তারের পরিমাণ দেশে লাখের কম হবে না। যদিও এরই মধ্যে র্যাবের অভিযানে আমরা বেশকিছু ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়তে দেখেছি। আইনের তোয়াক্কা না করে খোদ ঢাকা শহরে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ভূয়া ডাক্তারদের দ্বারা পরিচালিত প্রাইভেট ক্লিনিক। কিছু কিছু প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে মেধার বিকাশের চেয়ে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অথচ চিকিৎসা পেশার এসব নৈরাজ্য দেখার যেন কেউ নেই।
এখন কথা হচ্ছে তাই বলে নির্বিচারে পুরো ডাক্তার সম্প্রদায়কে আমরা নির্বিচারে কসাই বলতে পারি কি-না? অনেক সময় ডাক্তারদের সীমাবদ্ধতা, রোগীকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা আর স্বদিচ্ছা চোখে পড়ে না কারো। অভিযোগ একটাই, ভুল চিকিৎসা, তা না হলে রোগী মরবে কেন? ধরুন এমন রোগ যার কারণে মৃত্যু অনেকটা অবধারিত তাই ডাক্তার সদ্ বিশ্বাসে রোগী বাঁচবেনা বলে অভিমত দিলেন আর তাতেই হার্ট এটাকে রোগীটি মারা গেলো। এতে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লোক সমাগম করে কসাই কসাই চিৎকার দিয়ে শুরু হয়ে গেল ভাংচুর আর ডাক্তারের উপর উত্তম-মধ্যম। অথচ দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৯৩ ধারা অনুযায়ী এটা কোন অপরাধ নয়।
ঠিক আছে যদি কোন ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের অবহেলার অভিযোগ উঠে তাহলে তাহলে দন্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী মামলা করা যেতে পারে এবং আইনগত প্রক্রিয়ায় সাজা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
কিন্তু পরিকল্পিত হামলা সম্পূর্ণ বেআইনী। যদিও চিকিৎসক নির্যাতন এবং হাসপাতালে হামলা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং সারাবিশ্বেই একটি গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষায় নির্দিষ্ট আইনের এখনও ঘাটতি আছে। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ২০০৮ সাল থেকে মোট ১৮ টি প্রদেশে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন পাস হয়েছে। আবার নেপালে স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য ২০১০ সালে আইন পাস করে। তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশে শিঘ্রই চিকিৎসা সেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৮ পাস হতে যাচ্ছে।
কনফুসিয়াসের কাছে তার এক শিষ্য জানতে চাইল, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক উপাদানগুলো কি কি?’ জবাবে কনফুসিয়াস বলেন, ‘খাদ্য, নিরাপত্তা এবং জনগণের আস্থা অর্জন’। শিষ্য পুনরায় জানতে চাইল, ‘দুর্যোগ মুহূর্তে জরুরী প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে যদি কোন কিছু উৎসর্গ করতে হয়, তবে সেটি কি?’ কনফুসিয়াস উত্তরে বলেন, ‘খাদ্য বা নিরাপত্তা যদি বিসর্জন দিতেও হয়, তবুও জনগণের আস্থা যেন কখনও না হারায়।’
আইনজীবী, বিচারক, ডাক্তার, শিক্ষকতা, পুলিশ ও সাংবাদিকতা হচ্ছে মহৎ পেশা। এই পেশাগুলোতে যদি নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে তাহলে একটি রাষ্ট্র পঙ্গু ও অচল হয়ে যাওয়া অবধারিত। তাই এই পেশার মানুষগুলোকে কনফুসিয়াসের মতে অবশ্যই রাষ্ট্রের জনগনের আস্থা অর্জন করতে হবে।
অতএব এখনই উপযুক্ত সময় রোগী-চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকারকে উপযুক্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন: চিকিৎসা সেবাকে যারা ব্যবসার হাতিয়ার বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ; ভুয়া ডাক্তার চিহ্নিত করে আইনের আওতাভূক্তকরণ; মেডিক্যাল শিক্ষার মান আরো যুগপোযোগী করার প্রচষ্টা অব্যাহত রাখা; ডাক্তারদের শুধু মেডিক্যাল শিক্ষার বাইরেও রোগী এবং আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে আচার আচরণ কিভাবে করতে হয়, সে শিক্ষার ব্যবস্থা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করণ; পর্যাপ্ত সরকারী হাসপাতাল স্থাপন ও ডাক্তার নিয়োগের পাশাপাশি সেবার মান নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ।
পরিশেষে সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ নির্বিচারে কসাই বলে এই মহান পেশার মানুষগুলোকে ছোট যেন না করি!
লেখক: ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ও আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়