সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে অপরাধের মামলার সংখ্যা প্রতিবছর হু-হু করে বাড়লেও কমছে দণ্ডের হার। ২০১৪ সালে ঘোষিত ৪ মামলার রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের দণ্ড হয়। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪টি মামলার রায় ঘোষিত হয়। এর মধ্যে মাত্র একটিতে আসামিরা দণ্ডিত হয়েছেন। অপর ৩৩ মামলায় সবাই খালাস পান।
ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩টি মামলা নিয়ে ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর এখানে মামলার আসে ৩২টি। ২০১৫ সালে ১৫২, ২০১৬ সালে ২৩৩, ২০১৭ সালে ৫৬৮ এবং চলতি বছরের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে মামলা আসে ২৬৭টি। অর্থাৎ ২০১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মামলা এসেছে মোট ১২৫৬টি। ওই মামলাগুলো তদন্তের পর পুলিশ প্রতিবেদন হয়ে ট্রাইব্যুনালে আসে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালে আসা ১২৫৬ মামলার মধ্যে বর্তমানে ৮২৭ মামলা বিচারাধীন। অপর ৪২৯টি মামলার মধ্যে ১০১টি অন্য আদালতে বিচার্য হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকি ৩২৮টি মামলার মধ্যে সর্বাধিক ২২০টিতে পুলিশ অভিযোগ মিথ্যা মর্মে ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দাখিল করে। ট্রাইব্যুনাল মামলাগুলোর পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ করে নিষ্পত্তি করেন। অবশিষ্ট ১০৮ মামলার মধ্যে ৪২ মামলায় ট্রাইব্যুনাল চার্জগঠনের শুনানির পর্যায়ে আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়। বাকি ৬৬ মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। এতে ৫৬ মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। বাকি ১০টিতে আসামিরা দণ্ডিত হয়েছেন।
রায় ঘোষিত হওয়া ৬৬ মামলার মধ্যে ২০১৩ সালে সাজা এবং খালাসের কোনো রায় নেই। ২০১৪ সালে সাক্ষ্যপ্রমাণের পর ৪ মামলার রায় ঘোষিত হয়। ৪টিতেই আসামিরা দণ্ডিত হয়। ২০১৫ সালে রায় ঘোষিত ৬ মামলার মধ্যে ১ মামলায় দণ্ড এবং ৫ মামলায় আসামিরা খালাস পান। ২০১৬ সালে ২১ মামলায় রায় ঘোষিত হয়, যার ১৭ মামলায় আসামিরা খালাস পায়। ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪টি মামলার রায় ঘোষিত হয়, যার ৩৩টি মামলায় আসামিরা খালাস পায় এবং ১টিতে আসামি দণ্ডিত হয়।
আবার অব্যাহতি পাওয়া ৪২ মামলার মধ্যে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে কোনো অব্যাহতি নেই। ২০১৫ সালে ২টি, ২০১৬ সালে ১৭টি এবং ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩১টি মামলায় আসামিদের চার্জ শুনানিতে অব্যাহতি দিয়েছেন। ওই সব মামলায় তদন্তের পর আসামিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে চার্জশিট দাখিল করা হয়।
এ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া এফআরটি হওয়া ২২০ মামলার মধ্যে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে কোনো এফআরটি নেই। ২০১৫ সালে ২৩, ২০১৬ সালে ৪১ এবং ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪৬ মামলায় এফআরটি মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ সম্পর্কে ওই ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম গণমাধ্যমকে বলেন, খালাসের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো গাফিলতি নেই। খালাস বাড়ার পেছনে কারণ হলো অনেক মামলায়ই বাদী এবং আসামির মধ্যে আদালতের বাইরে আপস হয়, যার কারণে বাদী আদালতে এসে এমনভাবে সাক্ষ্য দেয় যে, মামলার অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া অনেক সময় তদন্তের ত্রুটির কারণেও খালাসের ঘটনা ঘটে।
মামলা এফআরটি হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিধান হলো, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে আইনে উল্লিখিত অপরাধগুলো তৃতীয় ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো। অনেক সময় তা তৃতীয় ব্যক্তির কাছে পৌঁছে না। তাই এফআরটি দেয় পুলিশ। আবার ফেসবুকে তথ্যটি ছড়ানোর পর তা আসামি নিজের পেজ থেকে ডিলিট করে দেয়। উক্ত তথ্যের বিষয়ে ফেসবুক আমাদের সহায়তা করে না। কারণ ফেসবুকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি নেই। ওই কারণেও মামলায় এফআরটি হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধিকাংশ মামলা হয় ওই আইনের ৫৭ ধারায়। ওই ধারায় বলা হয়, (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্র্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এই ধারার মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর রায়ের খসড়া ফাঁসের দায়ে ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলামের ১০ বছর এবং অপর ৪ আসামির ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই বছর ২৪ জুলাই রংপুরের এক বিচারককে মোবাইলে আপত্তিকর এসএমএস পাঠানোর দায়ে রেজওয়ানুল হক রিপন নামে এক আসামিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। আমাদের সময়