সরকারি কৌঁসুলি হলেন সদালাপী রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী
অ্যাডভোকেট মো: রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক প্রদানের অধিকার

মো: রায়হান ওয়াজেদ চৌধুরী: আমাদের দেশে চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থায় দেখতে পাই যে একজন নারী বিয়ের পর তার সবটুকু দিয়ে পরিবারটাকে আপন করে আগলে রাখতে চায়। আমৃত্যু স্বামীর অবলম্বন হয়ে সংসারে ঠিকে থাকতে চায়। শত অত্যাচার নিগ্রহ নিপীড়ন নির্যাতন তথা লাঞ্ছনা সহ্য করে স্বামীর সুখী সংসার প্রয়াসে বেচে থাকার আপ্রাণ চেস্টা করে । কিন্তু তা হয়ে উঠে না অনেক নারীর জীবনে । পুরুষশাসিত এই সমাজে এখনো নারীদের অধিকার বাস্তবায়ন অধরা রয়ে গেছে। “পুরুষই সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী” তা এখনো অনেকের মাঝে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। যার কারণে নারীরা পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য অধিকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় নারীরা তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে অসচেতন বা জানলেও নানা বাধা বিপত্তি ও ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক প্রদানের বিষয়টি। শুধু যে পুরুষ তথা স্বামী চাইলে স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে তা কিন্তু নয়। আইনমতে ক্ষেত্রবিশেষে একজন নারী তথা স্ত্রীও কিন্তু স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকার রাখে বা দিতে পারে। দেশের অধিকাংশ নারী জানে না তাদের এই অধিকার সম্বন্ধে বা জানলেও তারা বাস্তবায়ন করতে পারে না। স্ত্রীর কি আদৌ তালাক প্রদানের অধিকার রাখে? বা কখন স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে? অথবা কিভাবে একজন স্ত্রী স্বামীকে তালাক তথা বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারে? আজ আলোচনা করবো সে সব বিষয়ে।

তালাক কী?
‘তালাক’ একটি আরবি শব্দ; যার অর্থ ভেঙে ফেলা, ছিন্ন করা, বা ত্যাগ করা। মুসলিম আইনে তালাক স্বামী-স্ত্রীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক তথা দাম্পত্য জীবন এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষে বা যে কোনো একজনের পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তারা উভয়েই কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন; যার একটি হলো তালাক।আইনসিদ্ধ উপায়ে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করাকে তালাক বলে। তালাক প্রদানের ক্ষমতা বা অধিকার স্বামী ও স্ত্রীর সমান নয়। এ ক্ষেত্রে স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু আইনানুগ উপায়ে একজন স্ত্রীও তালাক প্রদান করতে পারেন। বিয়েবিচ্ছেদে স্ত্রীর এই অধিকারকে মুসলিম আইনে তিনভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তালাক-ই- তৌফিজ, খুলা ও আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ।

তালাক-ই-তৌফিজ
তালাক-ই-তৌফিজ হলো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত তালাক প্রদানের ক্ষমতা। স্বামী দি স্ত্রীকে বিবাহ রেজিস্ট্রির তথা কাবিন নামার ১৮ নাম্বার কলামে বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষমতা অর্পণ করে থাকেন এবং সে ক্ষমতার বলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চান তাহলে সে বিচ্ছেদকে ‘তালাক-ই-তৌফিজ’ বলে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের আশ্রয় ছাড়াই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। তালাক-ই- তৌফিজের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ ধারায় বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। স্ত্রী তালাকের নোটিশ-কপি চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবেন ও এক কপি স্বামীর কাছে পাঠাবেন। নোটিশ প্রাপ্তির পরবর্তী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। এজন্য নিকাহনামার ১৮ নাম্বার ঘরটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পূরণ করা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, বিয়েতে প্রশ্নকারীরা কনেকে এই প্রশ্নটি করেন না এবং ঘরটি শূন্য থাকে। কাজীদের অবশ্যই দুই পক্ষকে এই ঘরটি সম্পর্কে অবগত করা উচিত এবং বর ও কনেপক্ষ উভয়েরও বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। স্বামী যদি এ ঘরটি পূরণ না করেন অর্থাৎ কোনো কিছুই উল্লেখ না করেন অথবা কেবল সীমাবদ্ধ দু- তিনটি বা একটি ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা প্রদান করেন, তখন স্ত্রীর তালাক প্রদান করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। খুলা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক প্রদানের অধিকারের আরেকটি উপায় হলো ‘খুলা’।

খুলা
খুলা হলো স্বামী এবং স্ত্রীর আলোচনা সাপেক্ষে বিয়েবিচ্ছেদ। স্বামীকে খুলার মাধ্যমে বিয়েবিচ্ছেদে রাজি করানোর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর। অর্থাৎ বিচ্ছেদের উদ্যোগ অবশ্যই স্ত্রীর কাছ থেকে হতে হবে। প্রয়োজনে স্ত্রী স্বামীকে কোনো কিছুর বিনিময় প্রদান করবেন। সাধারণত বিনিময় বা ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্ত্রী তার আর্থিক দাবির কোনো অংশ ত্যাগ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে স্বামী রাজি থাকলে এভাবে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। খুলা তালাকের ক্ষেত্রে অন্য কোনো চুক্তি না থাকলে স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হবেন না; কিন্তু ইদ্দত পালনকালে স্ত্রী তার গর্ভের সন্তানের জন্য স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবক যেহেতু স্ত্রী, সেহেতু তালাকের নোটিশ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যান/ সিটি করপোরেশন বরাবরে স্ত্রীই পাঠাবেন।

আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ
স্ত্রী যদি তালাক-ই-তৌফিজ ও খুলার মাধ্যমে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটাতে ব্যর্থ হন এবং বিয়েবিচ্ছেদ হওয়া একান্ত প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তাকে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইনে বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করতে হবে (ধারা ২)। সেই আইনে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে কোন কোন কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়েবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে তালাকের জন্য আবেদন করতে হবে। আদালতের ডিক্রিমূলে তখন স্ত্রীর তালাক কার্যকর হবে। আইন অনুযায়ী স্ত্রী যেসব কারণে আদালতে তালাক চাইতে পারেন সেগুলো হলো

  • চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
  •  দুই বছর স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।
  • স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি কারাদ- হলে।
  • স্বামী কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছ যাবত দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
  • বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
  • স্বামী দুই বছর ধরে অপ্রকৃতিস্থ বা পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠরোগে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
  • বিয়ে অস্বীকার করলে। অর্থাৎ যদি কোনো মেয়ের বাবা বা অভিভাবক মেয়েকে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে দেন এবং সেই মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। তবে শর্ত হলো, মেয়েটির সঙ্গে স্বামীর দাম্পত্য সম্পর্ক (সহবাস) যদি স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনই কেবল বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাওয়া যাবে।
  • স্বামী একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে। অর্থাৎ স্বামী ১৯৬১ সালেরমুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
  • স্বামীর নিষ্ঠুরতারকারণে। নিম্নলিখিত আচরণগুলো ‘নিষ্ঠুরতা’ হিসেবে গণ্য হবে। (ক) অভ্যাসগত আচরণে স্ত্রীকে আঘাত করা, (দৈহিক আঘাত ছাড়াও মানসিক আঘাতও এর অন্তর্ভুক্ত, যা তার জীবন শোচনীয় বা দুর্বিষহ করে তুলেছে), (খ) অন্য কোনো খারাপ নারীর সঙ্গে জীবনযাপন বা মেলামেশা, (গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করা, (ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করা, (ঙ) স্ত্রীকে নিজস্ব ধর্মপালনে বাধা দেয়া, (চ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, তাদের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুসারে সমান ব্যবহার না করা, (ছ) এছাড়া মুসলিম আইনে বিয়েবিচ্ছেদের জন্য বৈধ বলে স্বীকৃত অন্য যে কোনো কারণে স্ত্রী পারিবারি আদালতে বিয়েবিচ্ছেদের দাবি করতে পারবে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতনকে বোঝাবে না বরং যে কোনো মানসিক নির্যাতনও নিষ্ঠুরতার অন্তর্ভুক্ত হবে। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইনে ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন: হাসিনা আহমেদ মামলায় আদালত মন্তব্য করেছেন যে স্ত্রীর অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করা হলে স্ত্রী আদালতে বিয়েবিচ্ছেদ চাইতে পারবে। এছাড়া হোসনে আরা বেগম মামলায় আদালত ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতন বোঝাবে না বরং সচ্ছল কোনো পরিবারে কোনো স্ত্রীকে (যার অভ্যাস নাই) যদি প্রাত্যহিক গৃহকর্ম করতে বাধ্য করা হয় তাহলে সেটিও নিষ্ঠুরত বলে গণ্য হবে।’ ওপরে যে কোনো এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়েবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। অভিযোগ প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারেন। যদি আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেয় তাহলে তার পরের সাতদিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউপি/ পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে পাঠাবেন। স্বামীর অবস্থান জানা না থাকলে মুসলিম বিয়ে-বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯-এর ধারা ৩ অনুসারে তার উত্তরাধিকারদের কাছে নোটিশ দিতে হবে।

১৯৬১ সালের মুসলি পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী তালাকের নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবেন সেদিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে। গর্ভাবস্থায় বিয়েবিচ্ছেদ হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। এ ক্ষেত্রে ৯০ দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হবে। স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।

স্ত্রী তালাক দিলেও কি মোহরানা পাবে
স্ত্রী তালাক দিলেও মোহরানার টাকা তাকে দিতে হবে এবং তালাক কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ভরণপোষণ করতে হবে। তবে দাম্পত্য মিলন না ঘটলে এবং মোহরানা সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকলে স্ত্রী মোহরানার অর্ধেকের অধিকারী। ১৯৩৯ আইনের ৫ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, এই আইনের কোনো কিছুই কোনো বিবাহিত নারীর বিয়েবিচ্ছেদের ফলে মুসলিম আইনানুসারে তার দেনমোহর বা এরকোনো অংশের ওপর কোনো অধিকারকেই প্রভাবিত করবে না।

লেখক: শিক্ষানবীশ আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট। ই-মেইল – ll.braihan@gmail.com