জাল জামিন আদেশ তৈরিতে হাইকোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এক শ্রেণির আইনজীবী তদবিরের মাধ্যমে তাদের দিয়ে বিভিন্ন সময়ে জাল জামিন আদেশ তৈরি করছে। হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান কমিটি এর সত্যতা পেয়েছে। অনুসন্ধানে বিবিধ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করা গেলেও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, তাদের সহকারী ও মামলার তদবিরকারককে (ডিপোনেন্ট) চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
পরে হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে আদালত জামিন জালিয়াতির ঘটনায় ফৌজদারি বিবিধ শাখার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান ওই আদালতের সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আলী জিন্নাহ।
জামিন জালিয়াতি রোধে ১৩ দফা সুপারিশ
এ দিকে জামিন জালিয়াতি রোধে তের দফা সুপারিশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। সুপারিশে জামিন আবেদনে টেন্ডার নম্বর পড়ার সময় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সদস্য নম্বর উল্লেখ রাখা, এফিডেভিট করার সময় তদবিরকারকের ভোটার আইডি কার্ড অথবা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংরক্ষণ করা, ফাইলিং ও এফিডেভিট শাখায় আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারি সনাক্তকরনের লক্ষ্যে ডাটাবেস তৈরি, জামিন আদেশের কপি প্রস্তুত ও স্বাক্ষর করা এবং বিচারপতিগণের স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখার সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা, আদালত থেকে শাখায় মোশন মামলার (জামিন আবেদন) নথিসহ অন্যান্য নথি গ্রহণকারীর একটি প্রাপ্তি রেজিস্টার সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে।
সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, শাখায় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে নথি মুভমেন্টের (প্রেরণ) সময় মুভমেন্ট রেজিস্টারে শুধু এন্ট্রি দেওয়া হয়। কিন্তু গ্রহণকারীর স্বাক্ষর নেয়া বা রিসিভ দেখানো হয় না। ফলে নথি খোজার ক্ষেত্রে গ্রহণকারী অস্বীকার করলে নথি গ্রহনের বিষয়ে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। কাজেই প্রতিটি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেই গ্রহণকারীর স্বাক্ষর রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া শাখায় শৃঙ্খলা বজায় রাখাও জবাবদিহিতার স্বার্থে শাখার তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যে নথিতে স্বাক্ষর করা, নথি রিসিভ করা, টাইপ হওয়া, নথি যথাযথভাবে র্যাকে রাখা প্রভৃতি বিষয় তদারকির জন্য সহকারি রেজিস্ট্রার কর্তৃক আলাদা কর্মবন্টন প্রস্তুত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের একটি ইয়াবা মামলার দুই আসামি আহমেদ নূর ও মো. রাসেলকে কারাগার থেকে বের করতে হাইকোর্টের দুই বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে তৈরি করা হয় জাল জামিন আদেশ। ওই আদেশনামা কারাগারে দাখিল করে বের করে নেওয়া হয় দুই আসামিকে। বিষয়টি নজরে এলে বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. খসরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গত ৩০ মে ঘটনাটি তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশের পরই হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানীকে প্রধান করে চার সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। গঠিত কমিটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বেঞ্চ কর্মকর্তাগণ, এমএলএসএস, ফৌজদারি বিবিধ শাখার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ, কমিশনার অব এফিডেভিট, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের আইন কর্মকর্তা ও এমএলএসএসসহ ১৭ জনের জবানবন্দি গ্রহন করেন।
এদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইকোর্টের ফৌজদারি মিস (বিবিধ) শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ প্রতিনিয়ত নিজ দায়িত্বের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন মামলার তদবির করছেন। সংশ্লিষ্ট শাখার রেজিস্টার(খাতা)সূমহ পর্যালোচনায় এটা বেরিয়ে এসেছে। এমনকি যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী মামলার তদবির করছেন তাদের নাম সংশ্লিষ্ট মামলার পাশে নোট দিয়ে রাখা হয়েছে। এরূপ অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে জালিয়াতিপূর্ণ জামিনাদেশ তৈরির মত ঘটনা ঘটেছে।
জালিয়াতিতে যারা জড়িত
প্রতিবেদনে জালিয়াতিপূর্ণ জামিন আদেশ প্রস্তুতের ঘটনায় ফৌজদারি বিবিধ শাখার এমএলএসএস মঞ্জু রাণী কৈরীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মঞ্জু রাণী অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে জাল-জালিয়াতিপূর্ণ কাগজ গ্রহন করে জাল জামিন আদেশ প্রস্তুতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছেন। এমনকি নিজ দায়িত্বের বাইরে গিয়ে তিনি ফৌজদারি বিবিধ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আ: বাসেদের টেবিলে রক্ষিত রেজিস্টার খাতায় এন্ট্রি (অন্তর্ভূক্ত করা) দিয়েছেন। মামলার মূল নথি শাখায় না থাকার জন্য দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। এছাড়া দায়িত্বে না থাকার পরেও মঞ্জু রানীর অনুরোধে এবং তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মোশনের নাম্বারিং (জামিন আবেদন) এন্ট্রি করার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখার মুদ্রাক্ষরিক তথা অফিস সহকারি মো. মনিরুজ্জামান মনি, ড্রাফট এবং কম্পেয়ার করার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা মৌসুমি দেব, জামিন আদেশ টাইপ করার জন্য অফিস সহকারি মো. মুজিবুর রহমান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল বাসেদ উক্ত জালিয়াতির ঘটনায় পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। এতে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব চরমভাবে অবহেলা করে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মচারীদের মধ্যে যথাযথ দায়িত্ব বন্টন ও তদারকির মাধ্যমে শাখার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহকারি রেজিস্ট্রার বেগম সুলতানা এবং সুপারিনটেনডেন্ট মো. মুজিবুর রহমান, রশরঞ্জন মন্ডল ও মো. জামালউদ্দিন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
হদিস নেই আইনজীবীর, পাওয়া যায়নি নথি
সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে কমিটি বলছে, ফাইলিং শাখার রেজিস্টার খাতায় আইনজীবী হিসেবে শফিকুল আলম এর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ওয়েবসাইটে মো. শফিকুল আলম নামে দু’জন আইনজীবীর সন্ধান পাওয়া যায়। ফাইলিং শাখার রেজিস্টার খাতায় আইনজীবীর সদস্য নম্বর উল্লেখ না থাকায় জালিয়াতিতে জড়িত প্রকৃত আইনজীবীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় ও যোগসাজশে মামলার নথি সরানো হয়েছে।