‘পুলিশ যখন গ্রেফতার করে তখন বারবার বলেছি, সে কোনো অপরাধ করেনি। তাকে ছাড়া আমি একেবারেই অচল। তোমরা তাকে ছেড়ে দাও। আজ আমার কথাই প্রমাণিত হলো। ২২ মাস পর ছেলেকে পেলাম কিন্তু হারালাম আমার দুই চোখ। ছেলের অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টি হারিয়েছি। কে এখন ফিরিয়ে দেবে আমার দুই চোখের দৃষ্টি? আর কে বা ফিরিয়ে দেবে আমার ছেলের হারানো দিনগুলো।’
এভাবেই বলছিলেন ভুয়া পরোয়ানায় ২২ মাস কারাগারে থাকা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার মাশডাইল এলাকার বাসিন্দা হোটেলকর্মী কপিল উদ্দিনের মা সাথী বেগম। কপিল উদ্দিনকে ২২ মাস আগে রাজধানীর পল্টন থানার একটি মাদক মামলার পরোয়ানায় গ্রেফতার করে ফতুল্লা থানা পুলিশ। কিন্তু ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ এরফান উল্লাহ মামলার সঙ্গে কপিলের সম্পৃক্ততা খুঁজে না পেয়ে তাকে মুক্তির আদেশ দেন। এ ছাড়া গাজীপুর জেলারকে এ বিষয়ে জবাব দেয়ার জন্য কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন। ফলে ২২ মাস পরে মুক্তি পান কপিল উদ্দিন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গণমাধ্যমকে এ প্রসঙ্গে বলেন, কপিল উদ্দিনকে যে ওয়ারেন্ট মূলে গ্রেফতার করা হয় তা সঠিক ছিল না। বিনাবিচারে তাকে ২২ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, ‘ভুয়া পরোয়ানায় ২২ মাস কারাগারে থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনলেই এই ধরনের অপরাধ কমে আসবে।’
যেভাবে গ্রেফতার থেকে কারামুক্ত হন কপিল
২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার মাশডাইল এলাকার বাসিন্দা কপিল উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঢাকার পল্টন থানার (৩২ (৭) ১৬ দায়রা- ১৭১৮/১৬) মাদক মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, যা ঢাকার প্রথম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এরপর নারায়ণগঞ্জ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পরোয়ানা মূলে কপিলকে ঢাকার আদালতে পাঠান। ঢাকার আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত বছরের ১৬ জানুয়ারি, ৩০ জুলাই ও ১০ আগস্ট তিন দফায় তাকে ঢাকার প্রথম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হয়। হাজতি পরোয়ানায় বিচারকের সিল দিয়ে স্বাক্ষর দেন সংশ্লিষ্ট আদালতের তৎকালীন পেশকার খলিলুর রহমান।
সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট মামলার সঙ্গে আসামির কোনো মিল না থাকায় হাজতি পরোয়ানায় কারাগারে পাঠানো হয়। এতে লেখা হয় মামলার সঙ্গে আসামির কোনো মিল নেই।
কোনো কারণ ছাড়াই চলতি বছরের ১২ জুলাই কাশিমপুর কারাগার থেকে কপিল উদ্দিনকে ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে (পল্টন ৩২ (৭) ১৬ দায়রা-১৫৯০৫/১৬) পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। এই মামলার আসামির সঙ্গে কপিল উদ্দিনের কোনো মিল নেই। বিচারকের নজরে আসে এই মামলাটি।
বিচারক নথি পর্যালোচনা করে দেখেন, মামলার সঙ্গে আসামির কোনো মিল নেই। কোনো খণ্ড নথিও পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকায় বিচারক স্ব-প্রণোদিত হয়ে কপিলকে ছাড়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। বিচারকের আদেশের দুই দিন পর কপিল কারামুক্ত হন।
এ বিষয়ে কপিল উদ্দিন বলেন, ‘আমাকে যখন গ্রেফতার করে তখন আমি বলেছি, আমি কোনো অপরাধ করিনি। কারাগারে থাকায় আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
কপিল উদ্দিনের ছোট ভাই সুমন বলেন, ‘আমার বড় ভাই কোনো অপরাধ করেনি। বিনাবিচারে তাকে ২২ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই। সে ২২ মাস কারাগারে থাকায় সংসারের যে ক্ষতি হয়েছে তারও ক্ষতিপূরণ চাই সরকারের কাছে।’
কফিলের মা সাথী বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে অপরাধী না। তাকে হয়রানি করার জন্য গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কার ভুলে ২২ মাস কারাগারে ছিল কপিল?’
নারায়ণগঞ্জ আদালতে গিয়ে দেখা যায়, পল্টন থানার ৩২ (৭) ০৬ নং মামলায় (দায়রা নম্বর-১৭১৮/০৬) কপিল উদ্দিনকে গ্রেফতার করে ফতুল্লাহ থানা পুলিশ। কিন্তু ডিসপার্স শাখা থেকে তাকে ঢাকার আদালতে পাঠানো হয় ১৭১৮/১৬ নম্বর মামলায়। কারাগারের কাস্টডি ওয়ারেন্টেও তা লেখা হয়। এই মামলায় কপিল উদ্দিনের কোনো নাম নেই। ওই সময় নারায়ণগঞ্জ আদালতের ডিসপার্স শাখার দায়িত্বে ছিলেন কনেস্টবল মোহাম্মদ আলী।
নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস বলেন, কনস্টেবল মোহাম্মদ আলী এটা ভুল করেছে। তার দায়ভার নিতে হবে তাকে।
এক মামলায় গ্রেফতার আর অন্য মামলায় ঢাকায় পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে কনেস্টবল মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ইচ্ছা করে করিনি।’ জাগোনিউজ