ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি সহজীকরণে সরকার ‘বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি আইন-২০১৮’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট এবং কম সময়ে ও কম খরচে মামলা নিষ্পত্তি করাই এ আইনের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডার) অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আইন কমিশন থেকে ইতোমধ্যে এ আইনের একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য খসড়াটি কমিশনের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে আইন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা (জেলা ও দায়রা জজ) ফউজুল আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিডা’র অনুরোধে আইনটি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যেন আকৃষ্ট করা যায়, বাণিজ্যিক বিরোধগুলো কম খরচে, কম সময়ে নিষ্পত্তি করা যায় সে লক্ষ্যে আইন তৈরির জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বর্তমানে বাণিজ্যিক বিরোধগুলো দেওয়ানি আইনের অধীন নিষ্পত্তি করা হয়। এতে করে অনেক সময় লাগে, খরচ বেশি পড়ে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য দুর্ভোগের। ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে হয়রানি ও দুর্ভোগ দূর করে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করাই এ আইনের মূল লক্ষ্য।
বাণিজ্যিক বিরোধের সংজ্ঞা
খসড়া আইনের সংজ্ঞা অংশে বাণিজ্যিক বিরোধ বলতে সর্বপ্রকার ব্যবসায়িক, আর্থিক, ব্যাংকিং এবং বাণিজ্যিক লেনদেন; আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য অথবা সেবা; অ্যাডমিরালিটি আইন ও মেরিটাইম আইন হইতে উদ্ভূত বিষয়াদি, আকাশযান ও সংশ্লিষ্ট উপকরণাদি ক্রয়, অর্থায়ন, লিজ প্রদান সংক্রান্ত বিষয়াদি; পণ্য পরিবহন, ভবনাদি নির্মাণ চুক্তি ও দরপত্র, নিরঙ্কুশভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত অস্থাবর সম্পত্তি চুক্তি, বিমুক্তি চুক্তি সংক্রান্ত, বিতরণ ও লাইসেন্স, ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শ প্রদান সংক্রান্ত চুক্তি, যৌথ মূলধনী চুক্তি, শেয়ার মালিকানা চুক্তি, আউটসোর্সিং শিল্পসেবা ও আর্থিক সেবা সংক্রান্ত বিনিয়োগ চুক্তি; বাণিজ্যিক এজেন্সি ও বাণিজ্যিক প্রথা, অংশীদারি চুক্তি, প্রযুক্তি উন্নয়ন চুক্তি, মেধাস্বত্ব অধিকার, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট, ডিজাইন, ডোমেইন নেইম, জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস অ্যান্ড সেমিকন্ডাক্টর ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটস; পণ্য বিক্রয় চুক্তি অথবা সেবার বিধান, তেল ও গ্যাসসহ অপরাপর প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন এবং সংরক্ষণসহ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম, বিমা ও পুনঃবিমাকরণ, এজেন্সি সংশ্লিষ্ট চুক্তি, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিরোধ, ডাম্পিং, অ্যান্টি ডাম্পিং থেকে উদ্ভূত বিরোধগুলোকে বোঝানো হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা
খসড়া আইনের ৪ ধারায় বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল এবং ২৯ ধারায় আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ৪ ধারায় বলা হয়, ‘ব্যবসা-বাণিজ’ থেকে উদ্ভূত মোকদ্দমা (বিরোধ) নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অর্থাৎ এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রয়োজনানুসারে জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ে এক বা একাধিক বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কোনো জেলা বা বিভাগে বাণিজ্যিক বিরোধ ট্রাইব্যুনাল না থাকলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা জজ আদালতে এ ধরনের মামলা করতে হবে। ৫ ধারায় বলা হয়েছে, অর্থঋণ ব্যতীত যাবতীয় বাণিজ্যিক বিরোধ সংক্রান্ত মামলা ৪ ধারায় প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালে দায়ের ও বিচার করা যাবে।
বিরোধ নিষ্পত্তি
আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, মামলা দায়েরের তারিখ থেকে ১২০ কর্ম দিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। ২২ ধারায় বলা হয়, মামলায় যে পক্ষ হেরে যাবে, সেই পক্ষকে মামলার যাবতীয় ব্যয় বহন করতে হবে। প্রতি শুনানির তারিখ ৫ হাজার টাকা হারে তফসিল-১-এর ছক অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল মামলার ব্যয় নির্ধারণ এবং খরচ বাবদ প্রাপ্য অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হবে। বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনালের রায়, ডিক্রি বা আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবে। আইনের ২১(১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার সারা দেশের জন্য ঢাকায় এক বা একাধিক ‘বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি আপিল ট্রাইব্যুনাল’ স্থাপন করতে পারবে। এ ট্রাইব্যুনাল হবে তিন সদস্যবিশিষ্ট।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশের ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল দায়ের করতে হবে। তবে সে ক্ষেত্রে আপিলকারী পক্ষকে আপিলের স্মারকের সঙ্গে খরচের টাকাসহ ডিক্রি করা অর্থের ২৫ শতাংশ টাকা ডিক্রি প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে রসিদ সংযুক্ত করতে হবে, অন্যথায় আপিল মামলা রেজিস্ট্রিভুক্ত হবে না। আপিল শুনানির জন্য উভয়পক্ষ একাধিক্রমে সর্বোচ্চ তিনটি এবং রিভিশন শুনানির জন্য একটি কর্মদিবস প্রাপ্য হবে। আপিল বা রিভিশন শুনানির ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করতে হবে।
খসড়া আইনটির ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে প্রতিকার চাওয়া যাবে। এ ছাড়া ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, মামলা চলার যে কোনো পর্যায়ে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মামলার উভয়পক্ষ আপন-মীমাংসা করতে পারবে। মোট ৩৯ ধারার এ খসড়া আইন বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত কমিশনের ওয়েবসাইটে রাখা হয়েছে। তবে প্রয়োজনে এ সময় বাড়ানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা।