১৯৮৩ সালে সামরিক সরকারের সময়ে জারি করা ‘দ্য মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিনেন্স’ ( মোটরযান অধ্যাদেশ)টি আদালতের নির্দেশে পরিবর্তন করে সড়ক পরিবহন আইন নামে পাস করতে যাচ্ছে সরকার। মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের পর সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তা অনুমোদন দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই আইন ভেটিং সম্পর্কিত নথি অনুমোদন দিয়েছেন। আইনের খসড়াটি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আইনটি আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদের একটি সূত্র।
বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে এই আইনের ভেটিং শেষ করল আইন মন্ত্রণালয়।
নতুন এই আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাসের বাধ্যবাধকতা এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। গত বছরের ২৭ মার্চ এই আইনের খসড়ায় মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দেয়।
এখন মন্ত্রিসভা এই আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে তা পাস করতে সংসদে তোলা হবে।
ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দ্য মোটর ভেহিকেল অর্ডিনেন্স ১৯৮৩ মার্শাল ল’ আমলে করা, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ওটাকে নতুনভাবে আইনে পরিণত করা হচ্ছে, এখানে বেশ বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
“পরিবহন সেক্টরটা অনেক ভাইব্রেন্ট, এখানে অনেকগুলো এজেন্সি কাজ করে এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে অনেক লিঙ্ক রাখতে হয়। এজন্য যথেষ্ট ওভারহোলিং করে নতুন আইন করা হয়েছে। শাস্তি বাড়ানো হয়েছে এবং কিছু নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো নিয়ে আসা হয়েছে।”
যা আছে নতুন আইনে
- আগের আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো শর্ত ছিল না। নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালককে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে।
- চালকের সহকারীরও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া থাকতে হবে। সহকারী হতে হলেও বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্স নিতে হবে। আগের অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের কথা থাকলেও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত ছিল না।
- গাড়ি চালনার জন্য চালকের বয়স আগের মতই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। আর পেশাদার চালকদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২১ বছর।
- নতুন আইনের খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেওয়া হবে। আগের আইনে এই ধরনের অপরাধের জন্য তিন মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
- চালকের সহকারীর লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে নতুন আইনের খসড়ায়।
- নতুন আইন পাস হলে কেউ গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না।এ আইন ভাঙলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
- ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে- এমন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চালকদের গ্রেপ্তার করতে পারবে।
ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছিলেন, চালকরা যাতে আইন মেনে চলেন, সেজন্য প্রস্তাবিত আইনে পয়েন্টভিত্তিক ব্যবস্থা চালু কথা বলা হয়েছে।
“পৃথিবীর অন্যান্য দেশে (চালকদের) পয়েন্ট কাটার সিস্টেম আছে। অর্থাৎ, ড্রাইভার যদি একবার দোষ করেন তাহলে একটা বা দুইটা পয়েন্ট কাটতে থাকে। এভাবে পয়েন্ট নিল (শূন্য) হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়।
“আমাদের দেশেও সে প্রস্তাবটি রাখা হয়েছে। ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিধিবিধান যদি কেউ অমান্য করে তাহলে আস্তে তার পয়েন্ট কর্তন হতে থাকবে। মোট ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকবে। কোন অফেন্সে কত পয়েন্ট কাটা যাবে সেটা তফসিলে বলা আছে। পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে আর ড্রাইভিং থাকবে না।”
পয়েন্ট কাটা শেষে কারও লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে সে নতুন করে লাইসেন্স পাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, “তাকে ডিসকোয়ালিফাই করবে।”
অপরাধের জন্য চালকদের পয়েন্ট কাটা যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মোটরযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ না করলে এক পয়েন্ট কাটা যাবে।
ড্রাইভিং সনদ পেতে চালক ও তার সহকারীদের শিক্ষাগত সদনের বাধ্যবাধকতার বিষয় শফিউল আলম বলেন, “(চালককে) অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে এই শর্ত যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আগে লেখপড়ার এই সিলিংটা ছিল না। চালকের সহকারীকে কমপক্ষে লিখিবার ও পড়িবার সক্ষমতা থাকিতে হইবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তার লেখাপড়া থাকতে হবে।”
অপরাধ ও দণ্ড আইন থেকে বের করে খসড়ায় তফসিল আকারে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ছয় মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার দণ্ডে দণ্ডনীয় যে অপরাধগুলো সেগুলো পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে।
“পেশাদার ও অপেশাদার চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগবে। যদি কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায় অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। এ ধরণের অপরাধের জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে।”
আগের অধ্যাদেশে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহারের জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও প্রস্তাবিত আইনে জেল ২ বছর রেখে জরিমানা ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ফিটনেট চলে যাওয়ার পরেও মোটরযানের ব্যবহার করলে এক বছরের জেল বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এই অপরাধে আগের আইনে ছয় মাস জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হত। মোটরযানের মালিককে এই সাজা দেওয়া হবে।
দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে শফিউল বলেন, দণ্ডবিধিতে তিন রকমের বিধান আছে।
“নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের সাজা হবে। খুন না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী ৩ বছরের কারাদণ্ড হবে।”
বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে কাউকে নিহত বা আহত করলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী সাজা হবে। দুই গাড়ি পাল্লা দিয়ে দূর্ঘটনা ঘটালে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
দুর্ঘটনায় না পড়লেও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্য আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এক্সেল বা ওজনসীমা অতিক্রম (৫ টন ধারণক্ষমতার ট্রাক এর থেকে বেশি ওজন পরিবহন করলে) করলে গাড়ির মালিক ও চালককে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হবে।
মোটরযান চলাচলে সাধারণ নির্দেশাবলী নামে একটি নতুন ধারায় ২৫টি নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জম ব্যবহার করতে পারবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে।
সিট বেল্ট না বেধে গাড়ি চালানো; মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং বয়জ্যেষ্ঠ যাত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসবেন না বা বসার অনুমতি দেওয়া যাবে না, এটা লঙ্ঘন করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড করা হবে।
“মহিলাদের সিটে বসতে না দিয়ে যদি অন্য কেউ (পুরুষ যাত্রী) বসে যায় তার জন্য এক মাসের জেল বা ৫ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।”
মদ পান করে বা নেশাজতীয় দ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালালে, সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালালে, উল্টো দিকে গাড়ি চালালে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, চালক ছাড়া মোটরসাইকেল এক জনের বেশি সহযাত্রী ওঠালে, মোটর সাইকেলের চালক ও সহযাত্রীর হেলমেট না থাকলে, ছাদে যাত্রী বা পণ্য বহন করলে, সড়ক বা ফুটপাতে গাড়ি সারানোর নামে যানবাহন রেখে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে, ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো মোটরযান চলাচল করলে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।