যেখানেই ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, সরকারি সম্পদ আত্মসাতের ঘটনা- সেখানেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজধানী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে। কমিশনের হটলাইন ১০৬ চালু হওয়ায় দুদক এখন মানুষের ঘরে ঘরে। গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লার যে কেউ যে কোনো সময়ে বিনা খরচে এ নম্বরে ফোন করে দুর্নীতির অভিযোগ জানাতে পারছেন।
সূত্র জানায়, ১০৬ এখন দুদকের রাডার। এক জায়গায় বসেই এই রাডারে সারাদেশের দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ অভিযানের ফলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। বেড়েছে তাদের মাঝে অস্থিরতা। অফিসের ভেতরে-বাইরে থেকে ১০৬-এ ফোন করে কখন কে বা কারা ঘুষ, দুর্নীতি ও জালিয়াতির খবর বলে দেন- এই ভয় তাদের মধ্যে ঢুকেছে।
দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো মানুষ প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হটলাইনে কল করে দুর্নীতির যে কোনো তথ্য ও অভিযোগ জানাতে পারবেন।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখান থেকে অনিয়ম, ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে- তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেই অভিযান চালানো হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ দুর্নীতি ও প্রতারণার শিকার হয়ে কোথাও আশ্রয় নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে হটলাইন চালু করে কমিশন বঞ্চিত, অবহেলিত, প্রতারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ১০৬-এ ফোন করে অভিযোগ জানাচ্ছেন। দুর্নীতিবাজদের এখন আর পালানোর জায়গা নেই।
সূত্র জানায়, গত জুলাইর শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে কমিশন এনফোর্সমেন্ট সেলের কার্যক্রম শুরু করেছে। অফিস-আদালতে হয়রানি ও ভোগান্তির খবর পাওয়া মাত্র হাজির হচ্ছেন সেলের সদস্যরা। হয়রানিমুক্ত কাজ নিশ্চিত করছেন তারা। দুদক পুলিশ ইউনিটের সদস্যরাও থাকছেন অভিযানে।
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ঢাকার বাইরে অনেক ক্ষেত্রে দুদকের কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট ডিসি, এডিসি, ইউএনও ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা এবং জালিয়াতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে।
এনফোর্সমেন্ট সেলের সমন্বয়কারী দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি অফিস চলে। সেই অফিসে যদি জনগণকে ঘুষ দিয়ে সেবা নিতে হয়, এর চেয়ে বড় কলঙ্ক আর কিছু থাকতে পারে না। জনগণের সেই দুঃসহ দুঃখ লাঘবের জন্যই হটলাইনে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী দ্রুতগতিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। আজ হোক, কাল হোক তাকে ধরা পড়তেই হবে।
জানা গেছে, অভিযান চলাকালে দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রয়োজনে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। তাদের উপস্থিতিতে অভিযোগকারীদের কাজটিও দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। এনফোর্সমেন্ট সেলের সমন্বয়কারীর নেতৃত্বে প্রতিদিন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে। ক্রমে সারাদেশে এই অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিআরটিএ, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বিমানবন্দর, জেলখানা, সিভিল সার্জন, ওয়াসা, হজ এজেন্সি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), শিক্ষা ভবন, বিভিন্ন হাসপাতাল, সিএজি, বিএসটিআই, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুই শতাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। সরকারের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে এই অভিযান পরিচালনা করা হবে। বিশেষ করে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
একদল তরুণ কর্মকর্তা নিয়ে চলছে দুদকের এই অভিযান। একটাই লক্ষ্য- দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই তা বন্ধ করা। কমিশন দুর্নীতি অনুসন্ধান, তদন্তের পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করেছে। আগামী দিনে আরও শক্তিশালী করা হবে।
গত বছরের ২৭ জুলাই দুদক অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন ১০৬ উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দুর্নীতির অভিযোগ জানাতে থাকে। লাখ লাখ অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। প্রথমে অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করা হয়। ভূমি, মাদক, পুলিশ, পল্লীবিদ্যুৎ, শিক্ষা, কোচিং বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, পাসপোর্ট, রেলওয়ে, ভিজিএফ, কাবিখা, কাবিটা, ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ, নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, নিয়োগ, অবৈধ সম্পদের বিষয়ে বেশি অভিযোগ আসতে থাকে। অভিযোগকারীরা ফোনে তাৎক্ষণিক সমাধানও চেয়েছিলেন। প্রতিদিন চলছে এ অভিযান। প্রয়োজনে সরকারি ছুটির দিনেও অভিযান চালানো হয়।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, সরকারি অফিসে একের পর এক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ায় ভয় ঢুকেছে অসৎ বড় বড় কর্মকর্তার মাঝেও। ওইসব কর্মকর্তা একজোট হয়ে দুদক হটলাইন বন্ধের পাঁয়তারা শুরু করেছেন। এ লক্ষ্যে তারা সরকারের উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কাছে তদবিরও করছেন। এ অপতৎপরতার কথা জেনে অভিযানের পরিধি আরও প্রসারিত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দুদক।
অভিযানে ভাঙা হলো ভবনের অবৈধ অংশ
দুদকের অভিযানের কারণেই রাজধানীর শান্তিনগরে রাজউকের নকশা-বহির্ভূতভাবে নির্মিত ভবনের অবৈধ অংশ ভেঙে দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কমিশনের হস্তক্ষেপে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ভবনের অবৈধ আট ফুট অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। শান্তিনগরের ১৩/১৭ নম্বর গ্রিনল্যান্ড প্লাজার আট ফুট নকশা-বহির্ভূতভাবে সরকারি রাস্তার জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল। ১০৬-এ ফোন করে নকশা-বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণের অভিযোগ দেওয়া হলে গত ২৪ জুন দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম শান্তিনগরে অভিযান চালায়। অভিযান চলাকালে নকশা-বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজউক আইন লঙ্ঘন করে রাস্তার ৮ ফুট জায়গায় ভবনটি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল।
অভিযানে পাহাড় কাটা বন্ধ
বান্দরবানের লামায় পাহাড় কাটার খবর পেয়ে কমিশনের নির্দেশে এরই মধ্যে জেলার ডিসির তত্ত্বাবধানে অভিযান পরিচালনা করে দুর্বৃত্তদের পাহাড় কাটা বন্ধ করা হয়। পরিচালনা করা হয় মোবাইল কোর্ট। জব্দ করা হয় বুলডোজার। স্থানীয় দুর্বৃত্ত এটিএম ইসমাইল শিকদার ইটভাটা স্থাপনের জন্য লামায় ৪৮ একরের একটি পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসের তৎপরতা শুরু করেছিল। ১৪ একর কাটার পর অভিযান চালিয়ে তা বন্ধ করা হয়। রক্ষা করা হয় ৩৪ একর পাহাড়। পরে পরিবেশ আইনে মামলা করা হয় ইসমাইল শিকদারের বিরুদ্ধে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।