২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড মামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দুই মামলার রায় আগামীকাল বুধবার (১০ অক্টোবর) ঘোষণা করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষ মামলার সব আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা খালাসের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণার দিন রাজধানীতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে পুলিশ। রায়কে কেন্দ্র করে কিংবা রায় বিপক্ষে যাওয়ার আবেগে কোনো পক্ষ যদি নাশকতার চেষ্টা করে তাদের শক্ত হাতে দমনের জন্য প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে রায়ের দিন জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী হামলার কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এর আগে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকায় ১ নম্বর অস্থায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১০ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
আলোচিত এ মামলায় ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সাফাই সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে আরও ২০ জনের।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী।
ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তীতে মামলাটি যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)।
২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আখন্দ।
তিনি ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন। জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়।
ফলে এ মামলায় এখন আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ জন। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ৩১ জন।
মামলার ৪৯ আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুল হুদা, পুলিশ কর্মকর্তা শহিদুল হক, খোদা বক্স চৌধুরী ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুর রহমানসহ ৩১ জন কারাগারে আটক আছেন।
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিনসহ ১৮ জন আসামি পলাতক রয়েছেন।
রায় ঘিরে শঙ্কা না থাকলেও সতর্ক পুলিশ
রায় ঘোষণার দিন রাজধানীতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে পুলিশ। রায়কে কেন্দ্র করে কিংবা রায় বিপক্ষে যাওয়ার আবেগে কোনো পক্ষ যদি নাশকতার চেষ্টা করে তাদের শক্ত হাতে দমনের জন্য প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে রায়ের দিন জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী হামলার কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রায় ঘোষণার দিন আসামি ও ঢাকাবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে আদালতের চারপাশের সড়কে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের বিশেষ আদালতে তল্লাশি চলবে, বসানো হবে চেকপোস্ট। এ ছাড়াও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে পুলিশ সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করবে। শহরজুড়ে থাকবে গোয়েন্দা নজরদারি। সব মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৫ সহস্রাধিক সদস্য এই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।
পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রায় ঘোষণার দিন কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার কোনো থ্রেট নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ও চেকপোস্ট থাকবে।’
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই মামলার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র পর্যায়ের নেতারা জড়িত সে কারণে নয়াপল্টনসহ বিএনপি অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় বিশেষ নজরদারি থাকবে। রায়ের পর কেউ যাতে সড়কে নেমে যান চলাচলে বিঘ্ন না ঘটাতে পারে, নাশকতা করতে না পারে সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে থাকবে অতিরিক্ত পুলিশ। নাশকতা হতে পারে এমন সম্ভাব্য স্পটগুলোতে আগে থেকেই পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।
রায়কে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী র্যাবের ব্যাটালিয়নগুলোকে সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, ‘রায়কে কেন্দ্র করে কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সেজন্য রাজধানীসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যক র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে।’
রায় ঘোষণার দিন নাশকতার বিষয়ে সোমবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘দেশের জনগণ এ মামলার রায়ের জন্য অধীর আগ্রহে রয়েছেন। এ রায়ের মাধ্যমে জাতি একটি কলঙ্ক থেকে মুক্ত হবে। ওই নৃশংস গ্রেনেড হামলার বিচার মানুষ দেখতে চায়। তাই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশে কোনো বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা নেই।’
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষে বহুল আলোচিত গ্রেনেড হামলার মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।