আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালত মূলত ১৪টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন। এই ১৪টি পয়েন্ট বিবেচনা করে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে ফাঁসি, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন ও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিয়ে রায়টি দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।
এই ১৪টি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে— ১. অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক, ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আসামি আহসান উল্লাহ কাজলের পশ্চিম মেরুল বাড্ডার ভাড়া করা বাসায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটনাস্থল ২৩ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার জন্য আসামিরা একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করে কি না ও গ্রেনেড নিক্ষেপকারীগণ এই ঘটনাস্থল থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করে কি না।
২. বাড্ডার আনন্দনগরে অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য পরিদর্শক রুহুল আমিনের ২/৫ নম্বর বাড়ি ভাড়া নিয়ে আসামি মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করে জঙ্গি কর্মে নিযুক্ত ছিল কি না এবং উক্ত বাড়ি থেকে মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি ২০০৫ সালে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় কি না।
৩. মেরুল বাড্ডায় লে. কর্নেল গোলাম রাব্বানীর (অব.) চারতলা বাড়ির তৃতীয়তলার উত্তর অংশের ফ্ল্যাট আসামিগণ ভাড়া নিয়ে গ্রেনেড সংরক্ষণ করতো কি না এবং বিভিন্ন গ্রেনেড হামলায় উক্ত বাড়ি থেকে গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়েছিল কি না।
৪. ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় রোড নম্বর ৫/এ, ৬১ নম্বর বাড়িটি ছিল বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর দ্বিতলা সরকারি বাসভবন। উক্ত বাসভবনে ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি, আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা তাজউদ্দিনগণ ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কি না। ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে গ্রেনেড প্রাপ্তি, অর্থবল, প্রশাসনিক সহায়তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পূর্বক ২০ আগস্ট তারিখে আসামি আহসান উল্লাহ কাজল ও মুফতি মঈন ওরয়ে আবু জান্দাল তৎকালীন উপ-মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির বাসা থেকে আাসামি মাওলানা তাজউদ্দিনের সরবরাহকৃত ১৫টি আর্জেস গ্রেনেড এবং নগদ ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন কি না।
৫. মিরপুর সেকশন-১ এর তিন নম্বর প্লটের মসজিদ-ই-আকবর কমপ্লেক্সে আসামি মাওলানা আবু তাহের শিক্ষকতা করতেন কি না, কমপ্লেক্স মসজিদের ইমাম সাহেবের অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে নামাজের সময় মুসল্লিদের উদ্দেশে জিহাদী বক্তব্য রাখতেন কি না। ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট আসামি আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহের, আব্দুস সালাম পিন্টু, মুফতি মঈন পরিকল্পনা ও অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় শলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করেন কি না।
৬. মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ রোডের ৩/১১ আলী অ্যান্ড নূর রিয়াল এষ্টেট বাড়ির নিচতলায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা হতো কি না। উক্ত বাড়িতে গ্রেনেড সংরক্ষণ করা হতো কি না এবং এই মামলার অনেক আসামি ওই বাড়িতে যাতায়াত করত কি না। আসামিগণ দেশের বাইরে ও দেশের ভেতরে হামলা পরিচালনার জন্য মাওলানা তাজউদ্দিনের কাছ থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করতেন কি না। মাওলানা তাজউদ্দিনের বিয়ের পর একই বাড়ির তৃতীয় তলায় বসবাস করতেন কি না এবং সেখোনে গ্রেনেড সংগ্রহ করতেন কিনা। উক্ত বাড়িতে আসামি আব্দুস সালাম পিন্টু ও মাওলানা আবু তাহেরের যাতায়ত ছিল কি না।
৭. গুলশান থানাধীন লালাসরাই মৌজাস্থিত রোড নং ১৩, ব্লক নম্বর ডি, বাড়ি নং ৫৩, বনানী মডেল টাউনস্থ আশেক আহমেদ, পিতা : আব্দুল খালেকের বাসা, যে বাসাটি হাওয়া ভবন নামে পরিচিত, উক্ত হাওয়া ভবন বিএনপি-জামায়াত ঐক্য জোট সরকারের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কি না। উক্ত ঘটনাস্থলে পলাতক আসামি তারেক রহমান অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্রমূলক সভা করেন কি না ও জঙ্গি নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় মিটিং করেন কি না।
৮. মোহাম্মদপুর থানাধীন আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এষ্টেট এলাকাধীন সাতগম্বুজ মসজিদে ঘটনার পূর্বে আসামি মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি, মাওলানা আব্দুস সালাম, মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আব্দুর রউফ, আব্দুল মাজেদ ভাট অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করে কি না।
৯. মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেটের কাছে হরকাতুল জেহাদ আল ইসলামীর অফিসে ও খিলগাঁও থানা এলাকায় হরকাতুল জেহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের প্রধান কার্যলয়ে বিভিন্ন সময় আসামিগণ অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক সভা ও ষড়যন্ত্র করে কি না।
১০. অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও পূর্ব পরিকল্পনার আলোকে পরস্পর যোগসাজোশে উদ্দেশমূলকভাবে ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেনেড আক্রমণ পরিচালনার সুবিধার্থে ও অপরাধীদের রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।
১১. অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও পূর্ব পরিকল্পনার আলোকে প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করে মামলার ঘটনায় ব্যবহৃত অবিস্ফোরিত সংরক্ষণযোগ্য তাজা গ্রেনেড আলামত হিসেবে জব্দ করার পরও তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে এবং আদালতের অনুমতি গ্রহণ না করে অপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংস করার ও আলামত নষ্ট করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না।
১২. অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত সভা ও পূর্ব পরিকল্পনার আলোকে পরস্পর যোগসাজোশে উদ্দেশমূলক ভাবে মূল আসামিদের সহায়তা করার লক্ষে, আসামিদের নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে ও পরবর্তীতে আসামিদের অপরাধের দায় থেকে বাঁচানোর সুযোগ করে দেয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না।
১৩. প্রকৃত আসামিগণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং তাদের রক্ষা করার জন্য প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অন্য লোকের ওপর দায় বা দোষ চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার লক্ষ্যে মিথ্যা ও বানোয়াট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না।
১৪. উল্লেখিত ঘটনাস্থলসমূহে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও পূর্বপরিকল্পনা করে পরবর্তীতে মূল ঘটনাস্থল আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সম্মুখে ঘটনার তারিখ ও সময় আর্জেস গ্রেনেড হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় নেতা-কর্মীসহ ২৪ জনকে হত্যা এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুরুতর করার অপরাধে দণ্ডবিধির ১২০বি/৩২৪/৩২৬/৩০৭/৩০২/১০৯/২০১/২১২/২১৭/২৩০ ও ৩৪ ধারায় শাস্তি প্রদান করা যায় কি না।