ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশে–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই সরকার সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর জন্য নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে নতুন একটি আইন চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে।
গতকাল সোমবার (১৫ অক্টোবর) মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া সম্প্রচার আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সম্প্রচার ও অনলাইন মাধ্যমে কোনো আলোচনা (টক শো) অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য–উপাত্ত প্রচার করা যাবে না। যেকোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত, গোপনীয় ও মর্যাদাহানিকর তথ্য এবং জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রচার নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে, কেউ তা করলে অপরাধ হিসেবে শাস্তি পেতে হবে।
চার বছর আগে ২০১৪ সালে জারি করা জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার পর গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এত দিন পর এসে সম্প্রচার আইনের খসড়াতেও ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ওই নীতিমালার বিধিনিষেধগুলো রাখা হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে সরকার সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এসব দেখভাল করার জন্য সাত সদস্যের কমিশন কাজ করবে। ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে কমিশনের হাতে। এই কমিশন সম্প্রচার লাইসেন্স ও অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গতকাল সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্প্রচার আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। একই বৈঠকে গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনের খসড়াও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই আইনে সাংবাদিকদের ‘শ্রমিক’–এর পরিবর্তে ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় এর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা আছে। সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এই দুটি আইনের খসড়া সম্পর্কে সরকারকে বেশ কিছু সুপারিশ ও আপত্তি জানিয়েছিল। সেগুলোর বেশির ভাগই উপেক্ষা করা হয়েছে।
সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রচারে বিধিনিষেধ
সম্প্রচার ও অনলাইন মাধ্যমে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত প্রচার করা যাবে না। দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাবধারার পরিপন্থী অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন সামরিক, বেসামরিক ও সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনে শিশুদের পরনিন্দা, বিবাদ ও কলহের দৃশ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের দৃশ্য দেখানো যাবে না। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে পারে এমন অনুষ্ঠান বা বক্তব্যও প্রচার করা যাবে না। এসব বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
সম্প্রচার আইনে খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো লাইসেন্স বা নিবন্ধন সরকারের অনুমোদন বা সম্মতি ছাড়া হস্তান্তর করা হলে তা বাতিল বা অকার্যকর হয়ে যাবে। কোনোভাবেই ৪০ শতাংশের বেশি লাইসেন্স হস্তান্তর করা যাবে না। সাজা পেয়েছেন এমন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, ঋণখেলাপি, একবার লাইসেন্স বা নিবন্ধন বাতিল হয়েছে এমন ব্যক্তিরা লাইসেন্স পেতে আবেদন করতে পারবেন না। ভোক্তারা তাদের অসুবিধার বিষয়ে সম্প্রচার বা অনলাইন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ বা নালিশ করতে পারবে। এ জন্য যথেষ্টসংখ্যক কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, নাশকতা ও সহিংসতা উৎসাহিত করে অথবা জনশৃঙ্খলা বিনষ্টের আশঙ্কা সৃষ্টি করে, অশ্লীল বা বিদ্বেষমূলক কোনো তথ্য প্রচার করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে।
খসড়া অনুযায়ী, সাত সদস্যের কমিশন সম্প্রচারকারী ও অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সহায়ক নির্দেশিকা প্রস্তুত করবে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা এবং জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোনো সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালালে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমিশন শাস্তি আরোপ, মামলা এবং প্রয়োজনে আরও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।
সম্প্রচার কার্যক্রম বলতে দেশ ও বিদেশ থেকে স্যাটেলাইট অথবা টেরিস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে অথবা কেব্লের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত সব ধরনের টেলিভিশন, বেতার ও অন্যান্য বিষয়বস্তু প্রচারকে বোঝাবে। ইন্টারনেটভিত্তিক রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র বা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখ বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ বা সম্প্রচার কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। অনলাইন গণমাধ্যমও এর আওতায় পড়বে।
আইনটি সম্পর্কে নোয়াব প্রশ্ন রেখেছিল, সম্প্রচারকারীদের সহায়ক নির্দেশিকা কি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা–২০১৪ থেকে ভিন্ন কিছু হবে? এ বিষয়টি আইনে পরিষ্কার করা হয়নি।
নোয়াব বলেছিল, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন–২০০৯ কার্যকর থাকার পরও ভোক্তার নালিশ গ্রহণ ও নালিশ নিষ্পত্তিকরণ–সংক্রান্ত ধারাগুলো পরিষ্কার নয়। নালিশ ছাড়াও কমিশনের বিশ্বাস জন্মালে সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টিও কোনোভাবে কাম্য নয়। কিন্তু খসড়া আইনে বিষয়টি রাখা হয়েছে।
নোয়াব বলেছিল, ইন্টারনেট যুক্ত করায় মনে হয় ছাপা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণও এই আইনের আওতাধীন। খসড়া আইনেও বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি।
গণমাধ্যমকর্মী আইন
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আগে গণমাধ্যমকর্মীরা চলতেন ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (চাকরির শর্তাবলি) আইন-১৯৭৪’–এর আওতায়। পরে তাঁদের শ্রম আইনের অধীনে আনা হয়। শ্রম আইনের অধীনে গণমাধ্যমকর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন আইন পাস হলে গণমাধ্যমকর্মীরা আর শ্রমিক থাকবেন না, তাঁদের গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে অভিহিত করা হবে।
এই আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে কর্মীদের কল্যাণের স্বার্থে ভবিষ্য তহবিল গঠন করতে হবে। এই তহবিল একটি ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালিত করবে, যেখানে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক এ গণামাধ্যমের কর্মীদের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকবে। প্রতিটি গণমাধ্যমকর্মীকে যেকোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে কমপক্ষে ৩৬ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। অতিরিক্ত কাজের জন্য ‘অধিক কাল ভাতা’ পাবেন।
প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, বেসরকারি টেলিভিশন, বেসরকারি বেতার ও অনলাইন গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য পৃথক ওয়েজ নির্ধারণ করবে। গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনের বিভিন্ন ধারা অমান্য করলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও আদায়ে ছয় মাস জেল হবে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে নোয়াব ৭ অক্টোবর গণমাধ্যমকর্মীদের আইনের খসড়ার ওপর মতামত পাঠায়। গতকাল মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া আইনটিতে দেখা যায়, নোয়াবের বেশির ভাগ প্রস্তাবই গ্রহণ করা হয়নি।
নোয়াব বলেছিল, গণমাধ্যমকর্মীর সংজ্ঞায় নিবন্ধিত সংবাদপত্রের মালিকানাধীন ছাপাখানার শ্রমিকদের অন্তুর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছাপাখানা সংবাদপত্রের মালিকানাধীন নয়। কিন্তু গণমাধ্যম আইনের খসড়ায় ছাপাখানার শ্রমিকদের গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে রাখা হয়েছে।
নোয়াব বলেছিল, প্রচলিত মজুরি বোর্ড অনুযায়ী চিকিৎসা ভাতা পরিচালিত হওয়া উচিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা ভাতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধার মতো হতে পারে না। কিন্তু খসড়া আইনে সরকারি কর্মচারীদের সুবিধা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নোয়াব সরকার মনোনীত ব্যক্তি কে হবেন, তা সুস্পষ্ট করতে বলেছিল। তা ছাড়া একাধিক আইন থাকায় এ ধরনের মীমাংসার বিধান গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছিল। কিন্তু খসড়ায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে সরকার মনোনীত ব্যক্তি কে হবেন, তা স্পষ্ট করা হয়নি। এ ছাড়া বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটাই হবে চূড়ান্ত।
এই আইন লঙ্ঘনকারীদের অপরাধ ও দণ্ড এবং আইন লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা সম্পর্কে নোয়াব আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, এটা কিছুটা স্বৈরতান্ত্রিক এবং সুশাসনের পরিপন্থী। কিন্তু খসড়ায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, সুযোগ–সুবিধা স্থগিত করাসহ জেল–জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।