রাজধানীতে দুই বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ১৮ দফা সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে সোমবার (১৫ অক্টোবর) এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদন ও মামলায় জারি করা রুলের ওপর আগামী ১৪ নভেম্বর শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। বিআরটিসির পক্ষে শুনানি করেন মুনিরুজ্জামান। স্বজন পরিবহনের পক্ষে শুনানি করেন এসএম শফিকুল ইসলাম বাবুল। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
এর আগে গত ৩০ মে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের দুর্ঘটনার ঘটনায় দুই বাস কর্তৃপক্ষের দায় নির্ধারণ ও দায়ীদের ক্ষতিপূরণ নিরূপণ করতে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন হাইকোর্টে।
ওই অনুসন্ধান কমিটির প্রধান বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) প্রফেসর ও ডিরেক্টর ড. মো. মিজানুর রহমান। কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে। বুয়েটের এআরআই বিভাগটি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা, বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান, কার্যকরী প্রশিক্ষণ ও এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা সীমিত সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। সরকারের এই বিভাগটির উন্নয়নে জোর দেয়া উচিত।
তাদের পক্ষ থেকে আরও ১৮টি বিষয় উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
- বুয়েটের এআরআই বিভাগটির উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রাংশ, সফটওয়্যারসহ সম্পর্কিত বিষয় বৃদ্ধিতে সরকারকে জোর দিতে হবে এবং এর জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
- সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, পুলিশ, বুয়েটের এআরআই, নিরাপদ সড়ক চাইসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে একটি কারিগরি টিম গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। বড় দুর্ঘটনাগুলো অনুসন্ধানে এই টিম কাজ করবে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই টিম ঘটনাস্থলে যাবে এবং দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্য ধ্বংস হওয়ার আগে তা উদ্ধার করবে।
- দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে সিসিটিভি বসাতে হবে। এতে শুধু দুর্ঘটনা অনুসন্ধানই নয় বরং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে।
- দুর্ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করা হয় না, তাই প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা নথিভুক্ত করতে হবে। দুর্ঘটনার বিষয়টি নথিভুক্তকরণ এবং গবেষণায় পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বুয়েটের এআরআই বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশকে অবশ্যই দুর্ঘটনার বিষয়ে নথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, অনুসন্ধান এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- রাজধানীর বাসগুলোর ভেতর এবং বাইরের অবস্থা খুবই করুণ। তা সত্ত্বেও বাসগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকাটা ভয়ঙ্কর বিষয়। বাসগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত সেফটি ফিচার (সাইডলাইট, হুইপার, হেডলাইট, টায়ার, প্রবেশের দরজা এবং জানালা) খুবই নিম্ন মানের। তাই কোনো বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হলে সেটির সুন্দর রঙ এবং সেফটি ফিচারগুলো ঠিক আছে কিনা তা দেখতে হবে। নয়ত সে বাসগুলো চলতে দেয়া যাবে না।
- বিআরটিসি বাসগুলো দৈনিক লিজভিত্তিতে ভাড়ায় চালিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বাসের ক্ষেত্রের এমন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে।
- চলন্ত অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখতে হবে। দরজার কাছে কোনো যাত্রী দাঁড়িয়ে যেতে দেয়া যাবে না। নির্দিষ্ট স্টপেজ বা বে’তে বাস থামার ব্যবস্থা করতে হবে।
- বাস বে বা স্টপেজগুলো সকল রুটে নির্দিষ্টভাবে পরিচিত থাকবে। কর্তৃপক্ষ সেখানে যাত্রীছাউনি তৈরি করবে। কোনো চলন্ত বাস ব্যস্ত সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করতে পারবে না। ট্রাফিক পুলিশকে এই নিয়মগুলো কঠিনভাবে মেনে চলতে হবে।
- বিআরটিএ কর্তৃক বাধ্যতামূলক একটি ড্রাইভিং স্কুল থাকতে হবে, যেখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইতে হবে। এই স্কুলের সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স টেস্ট করার জন্য আনা হবে না।
- থিওরি টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন টপিকের দ্বারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে তার দায়-দায়িত্ব, নিয়ম-কানুন শেখাতে হবে।
- ড্রাইভারদের থিওরি টেস্ট হবে বুয়েটের এআরআই দ্বারা। এবং বিআরটিএ প্রাকটিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা করবে।
- কোনো রকম দেরি না করে হাসপাতালগুলোকে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি রুল হাইকোর্টে পর্যবেক্ষণে রয়েছে। পাশাপাশি এসব রোগীর ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত চিকিৎসা এবং আর্থিক দিকগুলো বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে ট্রমা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
- ট্রিপ প্রতি বা দৈনিক ভিত্তিতে ড্রাইভার নিয়োগ পদ্ধতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে।
- ড্রাইভারদের বাস কোম্পানি মালিক কর্তৃক মাসিক বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
- দুর্ঘটনা পুনরাবৃত্তির রোধে ও বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধে রাজধানীতে বাস রুটগুলোকে ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিতে চলার পদ্ধতি চালু করতে হবে।
- বৈধ লাইসেন্সের ভিত্তিতে একটি রুটে মাত্র একটি কোম্পানির বাস চলবে।
- ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধিতিটি হবে রুট বা শহরভিত্তিক। তাই প্রতিটি রুট ভিন্ন ভিন্ন রঙিন কোডের দ্বারা আলাদা করা থাকবে।
- এই পদ্ধতিগুলোর ফলে যাত্রীদের আর্থিক সুবিধা হবে এবং বাস কোম্পানিগুলোর ড্রাইভারদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ হবে।