লঘু অপরাধে কারাগারে আটক বন্দীদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি বন্দী থাকায় চাপ কমাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বয়স্ক, অসুস্থ ও সাজার মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসা বন্দীরাও মুক্তি পাবেন। সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৪০১ জন বন্দীকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
এমনকি মাদক মামলায় কারাগারে আটক ২৭ হাজার ৪১৫ জন বন্দীর (সাজা হয়নি এখনো) বড় একটি অংশকেই মুক্তি দিতে চায় সরকার। যদিও দেশজুড়ে এখন মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ওই বন্দীদের বেশির ভাগ মাদকের বাহক হিসেবে ধরা পড়েছিলেন। তাঁরা বড় অপরাধী নন। তাঁদের বিরুদ্ধে করা মামলায় সাক্ষীও পাওয়া যাচ্ছে না।
এভাবে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার সরকারি প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে কারাগার খালি করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ঢোকাতেই সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান গণমাধ্যমকে বলেন, কোনো নীতিমালা বা প্রজ্ঞাপন জারি না করে নির্বাচনের আগে এভাবে বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। সরকারের এই উদ্যোগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীদের কারাগারে যাতে রাখা যায়, সে ব্যবস্থাই সরকার করতে যাচ্ছে—এমন সন্দেহ মানুষের মনে জাগবে।
কারা কর্মকর্তারা বলছেন, চুরি, ছিনতাই, মাদক বহনের ঘটনায় আটক বন্দীদের অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সাক্ষীর অভাবে বিচার শেষ হচ্ছে না। আবার শাস্তির মেয়াদের চেয়ে বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন কিন্তু বিচার শেষ হয়নি—এমন বন্দীরা জেল সুপারের কাছে অন্যায় স্বীকার করে আবেদন করেছেন। এসব আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
কেন এ উদ্যোগ নেওয়া হলো—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে কারাগারে বন্দীর চাপ কমানো। কারাগারে ৩৬ হাজার ৬১৪ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু আসামির সংখ্যা প্রায় ৯২ হাজার। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই লঘু অপরাধে আটক আছেন। সাক্ষীর অভাবে বিচার হচ্ছে না। বিচারাধীন মামলার এসব আসামির মুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করছে। দেশের সব কারাগারে এমনভাবে যাঁরা বিনা বিচারে তিন বছর পর্যন্ত আটক আছেন, তাঁদের এই প্রক্রিয়ায় মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কারাগারে বন্দীর সংখ্যা কমানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত মাসে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৪২ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন মামলা থেকে অব্যাহতি ও ১০৬ জন বিভিন্ন মেয়াদে জামিনে মুক্তি পান।
সাধারণত প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং দুই ঈদের আগে কিছু বন্দীকে (লঘু অপরাধ এবং কারাগারে শৃঙ্খলা মেনে চলা) মুক্তি দিতে বিভিন্ন কারাগার থেকে একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় সেই তালিকা সুপারিশের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়। এরপর আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী ওই বন্দীরা ক্ষমা পান। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি যেকোনো আদালতের দেওয়া দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা কমাতে পারেন।
আইনজীবী শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের এ ধরনের উদ্যোগের ফলে জনমনে যেন বিচারব্যবস্থা নিয়ে আস্থাহীনতার পরিবেশ তৈরি না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। আসামির নাম, অভিযোগের ধারা ও কারাবাসের সময় প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট আসামিকে মুক্তি দিতে হবে, না হয় জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। জনগণ ভাববে সরকার রাজনৈতিক বা অন্যায় উদ্দেশ্যে এসব করছে। প্রথম আলো