গত ৩৩ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় সোনা চোরাচালানের পাঁচ শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৪৯৫ জন। বেশিরভাগ মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। দুইশ’র বেশি মামলার অভিযোগপত্র এখনও দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থাগুলো। তবে বেশিরভাগ ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি না হলেও শতাধিক বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।
পুলিশ সদর দফতরের সূত্র জানায়, ১৯৮৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতে ২৬ সোনা চোরাকারবারির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এদের মধ্যে তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া, দণ্ডপ্রাপ্তদের আর্থিক দণ্ডও করা হয়েছে। তবে কয়টি মামলায় তাদের সাজা হয়েছে, কয়টি মামলা এখনও বিচারাধীন, অভিযোগপত্র হয়েছে কয়টির, তদন্ত চলছে কতগুলোর— সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি কেউই।
সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করে যারা
দেশে বিমান, স্থল ও সমুদ্রপথে সোনা চোরাচালান হয়। আর এর প্রতিরোধে কাজ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড। বিভাগীয় মামলার বাইরে ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব পুলিশের। থানা পুলিশ ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে। মামলার আসামি গ্রেফতার, অভিযোগপত্র দাখিল, বিচার শুরুর পর সাক্ষী হাজিরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পুলিশই করে।
বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি
বেশিরভাগ ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি না হলেও গত ৩৩ বছরে প্রায় ১০০ বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একজন উপ-পরিচালক জানান, নিয়ম অনুযায়ী চোরাচালানিসহ সোনা উদ্ধার হলে ফৌজদারি মামলা হয়, আর পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হলে হয় বিভাগীয় মামলা। বিভাগীয় মামলা দায়েরের তিন মাসের মধ্যে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া সোনা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে মামলা বেশি
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের এম. এ. জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে রয়েছে সোনা চোরাচালানিদের ব্যাপক তৎপরতা। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, সৌদি আরব, কাতার থেকে সবচেয়ে বেশি সোনার চালান আসে। আর তাই এই তিন বিমানবন্দরেই ধরা পড়ে বেশির ভাগ সোনার চালান, মামলাও হয় বিমানবন্দর থানা বা এর আশপাশের এলাকার থানাগুলোতে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামে।
সমন্বিত তথ্য নেই
গত ৩৩ বছরে সোনা চোরাচালান মামলার কয়টির বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, কতগুলো আদালতে মামলার বিচার চলছে— এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। অভিযানে উদ্ধার হওয়া সোনার মূল সমন্বয় করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। মোট মামলা,অভিযোগপত্র দাখিল ও বিচার প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি তাদের নথিপত্রে উল্লেখ থাকার কথা। কিন্তু তারা বলছে, মামলায় মূল ভূমিকা পুলিশের। আর পুলিশ বলছে, কয়টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে, তা শুধু আদালতই বলতে পারবে।
পাবলিক প্রসিকিউটরের বক্তব্য
ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) জানান, সোনা চোরাচালানের মামলাগুলো দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন আছে। এ কারণে খুব সহজে মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানানো সম্ভব নয়। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট আদালতের সঙ্গে সমন্বয় করেই কেবল মামলা নিষ্পত্তির পরিসংখ্যান জানানো সম্ভব। চট্টগ্রাম ও সিলেট আদালতের পিপি’র কাছ থেকেও একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।
মামলা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সোনা চোরাচালানের সঙ্গে সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। নানা কৌশল অবলম্বন করে বলে বেশিরভাগ সময়ই চক্রের মূল হোতা পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সোনার বাহক গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে মূল হোতার ঠিকানা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। আরও অনেক কারণেই তদন্ত প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।’
সিআইডির বক্তব্য
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সোনা চোরাচালানের মামলাগুলোর সঙ্গে অনেকগুলো পক্ষ থাকে। যে সোনা পাঠায়, যে বহন করে এবং যার কাছে সোনার চালানটি যায়— এই তিনটি পক্ষকে শনাক্ত করতে সময় লাগে। এছাড়া, সোনা চোরাচালানের জন্য বাংলাদেশ বেশিরভাগ সময় রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে। এসব কারণেই মামলার তদন্তে একটু সময় লাগে।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা
১৯৮৫ সালে সোনা চোরাচালানের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ওই বছর প্রায় সাড়ে ৯৬ কেজি সোনা উদ্ধার হয়। আর এই সোনা চোরাচালানের অভিযোগে গ্রেফতার হয় ৩১ জন। ১৯৮৬ সালে উদ্ধার হয় ১২০ কেজি ২২৫ গ্রাম সোনা, গ্রেফতার হয় ৩৮ জন। ১৯৮৭ সালে উদ্ধার হয় ৫ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৪ জন। ১৯৮৮ সালে উদ্ধার হয় ৬২ কেজি সোনা, আর গ্রেফতার হয় ২৫ জন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত উদ্ধার হয় সাড়ে ৩ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৩ জন। ১৯৯২ সালে উদ্ধার হয় সাড়ে ৪২ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৯ জন। ১৯৯৩ সালে উদ্ধার হয় এক কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় এক জন। ১৯৯৬ সালে উদ্ধার হয় ৩ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৫ জন। ২০০০ সালে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় ৫ কেজি সোনা। ২০০১ সালে উদ্ধার হয় ৯৫ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ১০ জন। ২০০২ সালে উদ্ধার হয় ১১৮ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৩ জন। ২০০৩ সালে উদ্ধার হয় ৮৫টি স্বর্ণের বার ও ২৭ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৯ জন। ২০০৪ সালে উদ্ধার হয় ২৬ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৩ জন। ২০০৮ সালে উদ্ধার হয় ২২ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ১৯ জন। ২০০৯ সালে উদ্ধার হয় ৫ কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ৪ জন। ২০১০ সালে উদ্ধার হয় এক কেজি সোনা, গ্রেফতার হয় ২ জন। ২০১১ সালে উদ্ধার হয় ৯ কেজি সোনা, আর গ্রেফতার হয় ১৪ জন। ২০১২ সালে উদ্ধার হয় ২৫ কেজি ৩৬ গ্রাম সোনা, গ্রেফতার ১৬ জন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী— ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত উদ্ধার হয় এক হাজার ৬২২ দশমিক ৭৭ কেজি সোনা, আর গ্রেফতার হয় ১২৬ জন। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত উদ্ধার হয় ১৭১৭ কেজি সোনা, আর গ্রেফতার হয় ১৮৯ জন। সূত্র : বাংলাট্রিবিউন