পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় ছিটমহলের জমির মালিকানাসংক্রান্ত ভূমি আইনের সংশোধন পাস হয়েছে। গতকাল সোমবার পাস হওয়া এই সংশোধিত আইনে যুক্ত হয়েছে নতুন দুটি ধারা। এতে সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের জমির স্থায়ী মালিকানা দিতে আর কোনো বাধা থাকল না।
গত ২৯ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোচবিহারে প্রশাসনিক বৈঠকে যোগ দিয়ে ঘোষণা করেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই জেলার ছিটমহলবাসীর জমির স্বত্ব দিতে হবে। আইন পাসে বিলম্ব হলে প্রয়োজনে অরডিন্যান্স জারি করে সাবেক ছিটমহলবাসীর দখলীকৃত জমির স্বত্ব তুলে দিতে হবে তাঁদের হাতে। এই নির্দেশের পর কোচবিহারের ভূমিরাজস্ব দপ্তর ছিটমহলবাসীর জমির স্বত্ব তাঁদের নামে দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করে। কাজ শুরু করে রাজ্যের ভূমি মন্ত্রণালয়ও।
গতকাল ভূমি সংশোধন বিল পাস হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদনের পর ১৭ হাজার একরের কিছু বেশি জমি দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারত পায় ৭ হাজার ১০০ একরের কিছু বেশি জমি। তা ছাড়া এই ছিটমহলের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৫৭৯ কোটি রুপি দিয়েছে রাজ্য সরকারকে। এখনো বাকি রয়েছে ৪২৬ কোটি রুপি। অথচ একটা সেতু তৈরিতেই খরচ হচ্ছে ৪০০ কোটি রুপি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এখন এই ছিটমহলে রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে। ছিটমহলবাসীর জন্য রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, বিদ্যুৎ, ব্যাংক হিসাব ইত্যাদি সবকিছুই করা হচ্ছে। এমনকি ছিটমহলের বাসিন্দাদের জন্য রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী, সবুজসাথি প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
ছিটমহল বিনিময়ের তিন বছর পার হলেও এখনো জমির স্বত্ব পাননি সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দারা। এতে খেপে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এক ঘোষণায় তিনি বলেন, তিন দিনের মধ্যে অরডিন্যান্স জারি করে হলেও ছিটমহলবাসীর জমির স্বত্ব দিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে রাজ্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আদেশ দেন। একই সঙ্গে ছিটমহলবাসীর নানা অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য ১৫ দিন সময় দেন। কেজিপ্রতি চাল দুই রুপি করে কেনা থেকে যেন ছিটমহলবাসী বঞ্চিত না হন, সেদিকে নজর দেওয়ারও নির্দেশ দেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব ছিটমহলের অবস্থান কোচবিহার জেলায়। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাতে ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৬২টি সাবেক ছিটমহল বিনিময় হয়েছিল। এই ছিটমহলের মধ্যে ভারতের ভূখণ্ডে ছিল বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছিল ভারতের ১১১টি ছিটমহল। দীর্ঘ ৬৮ বছর পর সেই ছিটমহল বিনিময় হয় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে। কোচবিহার জেলার পোয়াতুরকুঠি ছিটমহলে ১ আগস্ট সকাল নয়টায় প্রথম সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলে ভারতীয় পতাকা তোলেন কোচবিহারের জেলা প্রশাসক। এরপর পতাকা তোলা হয় পশ্চিম বাকালিছড়া ছিটমহলে। ৬৮ বছর পর ভারতের ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকেরা ভারতীয় নাগরিক হওয়ার সুবাদে ৫১টি ছিটমহলজুড়ে বইছিল আনন্দের বন্যা।
এই ছিটমহল বিনিময়ের পর বাংলাদেশের ৯২১ জন বাসিন্দা ওই বছরের ২২ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কোচবিহার জেলায় চলে যান। ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলের কোনো বাসিন্দা বাংলাদেশে ফিরে যাননি। হিসাব অনুযায়ী, ভারতের অভ্যন্তরে ছিল বাংলাদেশের ১৪ হাজার ২১৪ জন বাসিন্দা। আর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিটমহলে ছিল ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন বাসিন্দা। এবার ছিটমহলবাসীর ভোগদখলে থাকা জমি তাঁদেরই হাতে তুলে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য প্রশাসন। শুরুও হয়েছে পরচা তৈরির কাজ। বলা হয়েছে, এই ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ৭ হাজার ১১০ একর জমি। এই জমি ফিরিয়ে দিতে তৈরি করা হয়েছে ১৪ হাজার খতিয়ানের পরচা। কিন্তু প্রয়োজন ছিল জমির স্বত্ব দিতে ভূমি আইনের সংশোধন। গতকাল পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সেই আইন সংশোধন করা হলো।