বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী :
কারও বাবা-মা চিরজীবন বেঁচে থাকেন না। মানুষের জন্মই হয় একদিন মৃত্যুর স্বাদ লাভ কার জন্য। সবাই মরণশীল। তবুও এত কষ্ট হয় কেন চলে যাওয়ায়?
সবার বাবা সবার কাছেই অতি প্রিয়, মূল্যবান। আমরা সবাই দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মূল্যায়ন করি না, তেমনি বাবা জীবিত থাকতে বুঝতে পারি না কী ছায়ার নিচে নিজেকে রাখছি।
বাবা যেন বটগাছের ছায়া, রোদ-বৃষ্টিতে আশ্রয়ের স্থান। বিপদ-আপদে, রোগ-শোকে যার কাছে নির্দ্বিধায় যাওয়া যায়।
জীবনের ৫৬টি বছর কাটিয়েছি বাবার সঙ্গে। আমার বাবা বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মাসউদ একজন অতি ভালো ও আদর্শবান পিতা ছিলেন। ‘ছিলেন’ বললে ভুল হবে, তিনি এখনও আমার সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে থাকেন, এটা আমার অনুভব, বিশ্বাস। আমার শিক্ষাজীবনের প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত, আমার আইন অঙ্গনে প্রবেশের প্রথমদিন থেকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ছাত্রছায়ায় ছিলাম।
চলার পথে- কী পারিবারিক জীবন ক্ষেত্রে, পেশাজীবন ক্ষেত্রে অনেক ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হয়েছি। বাবা তার মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাকে তার বুকে আগলে রেখেছিলেন। এখন কেউ বলার নেই- আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজে ভালো তো জগৎ ভালো- নিজে ভালো থাকলে, ঠিক থাকলে সবই ভালো। মাথায় স্নেহের হাত বুলানোর কেউ নেই।
বাবা অনেক সময় বলতেন আমি খুব আবেগপ্রবণ, হুজুগে চলি, প্র্যাকটিকেল নয়, মুখটা ঠিক সময় বন্ধ রাখতে পারি না, যার কারণে অনেক সমস্যায় পড়ি। আমার সহ্য ক্ষমতার অবশ্য প্রশংসা করতেন। মাঝে মাঝে আমার লেখা রায় দেখে মুচকি হাসতেন।
জানা হয়নি সেটা তার গর্বের হাসি ছিল কি না। আমার কাছে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে খুব ভালোবাসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাত্রজীবনের কথা, রাজনীতির কথা গল্প করতেন। কারও বিরুদ্ধে কিছু বলা একদমই পছন্দ করতেন না।
বাবার ব্লাড প্রেসার, ব্লাড সুগার ইত্যাদি স্বাভাবিক ছিল। তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না।
২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর আমার দাদির মৃত্যুবার্ষিকীতে যথাযথভাবে মিলাদের আয়োজন করলেন। পরদিন আমি দাঁতের ডাক্তারের কাছ থেকে এসে দেখি টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার টেলিফোনে কথোপকথন প্রচার করা হচ্ছে। দেখতে বসেছি, আব্বাকে খুঁজলাম, দেখি শুয়ে আছেন। তিনি সবকিছু নিয়মমাফিক করতেন।
অসময়ে শুয়ে আছেন দেখে মনের ভেতর কেমন জানি ধক করে উঠল। দৌড়ে কাছে গেলাম, বললেন পেটে একটু ব্যথা অনুভব করছেন, একটু বমির ভাব লাগছে, ঠিক হয়ে যাবে। কোনো সময় কোনো অসুবিধার কথা বলতে চাইতেন না।
বুঝতে অসুবিধা হল না, ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। বিপৎকালীন সহায়ক আমার খালু জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আবদুল মালিককে ফোন করলাম, তিনি তখন সিলেটে অবস্থান করছিলেন।
একজন পরিচিত ডাক্তারকে আনলাম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। কেউ কিছু ধরতে পারলেন না। হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রামে দেখাল এনটিসটাইন পেঁচিয়ে গেছে হার্নিয়ার সঙ্গে। ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অস্ত্রোপচার হল, জ্ঞান ফিরল, সব ঠিকঠাক, কেবিনে আসবেন, হঠাৎ ভোরবেলা জানানো হল- শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়ায় লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়েছে।
পরবর্তীকালে তাকে তার প্রাণপ্রিয় হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হল। সেখানেই ২২ নভেম্বর ২০১৩ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন।
আমার বাবা বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ ১৯২৪ সালে সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং সিলেটের এমসি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন।
১৯৪৭ সালে সিলেট রেফারেন্ডামে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি সিলেট জেলা বারে ওকালতি শুরু করেন এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে Deputy Legal Remembrance পদে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করা হয়।
১৯৭৩ সালের ১৯ জুন তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালের ১৭ এপ্রিল আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন এবং সংবিধান নির্ধারিত ৫ বছর ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি জাতিসংঘের ৩৭তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। তিনি হজ ডেলিগেশনের প্রধান হয়ে হজ পালন করেন। তিনি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত হাইকোর্ট মাজার কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করে গেছেন তিনি।
এ উপমহাদেশের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা অবলোকন করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ‘Reminiscence of Few Decades and Problems of Democracy in Bangladesh’ নামে একটি বই লিখেছেন।
যাদের বাবা নেই, তাদের কষ্ট বুঝবে শুধু পিতৃহীনরা। আমার বাবা যেমন আমাকে ছোটবেলায় আদর-যত্নে লালনপালন করেছেন, ঠিক তেমনি সৃষ্টিকর্তা তাকেও যেন আদর-যত্নে রাখেন।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মাসউদের জ্যেষ্ঠ কন্যা