আজ ১০ ডিসেম্বর, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই দিবসটি পালন করা হবে। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
দিবসটি উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, প্রতি বছর এইদিন ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকল মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সরকার মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ কমিশন মানবাধিকার সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।’
অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ সব মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষা, সমানাধিকার, অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিতকরণে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সরকারের পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য আহ্বান জানাব।’
এদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মনে করে মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীরা। খুন, গুম, ধর্ষণ ও হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাদের শঙ্কা তুলনামূলক বেশি।
তারা বলছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না মিললে কোনও ঘটনার বিচার করা সম্ভব হবে না। যেসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, সেগুলোর যথাযথ তদন্তের জন্য কমিশন গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছেন তারা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসেব বলছে, এবছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পযন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ঘটনায় মারা গেছেন ৪৩৭ জন। গত ৪ মে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। তবে ১৫ মে থেকে মাদক নির্মূল অভিযানে হার্ডলাইনে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অভিযানে ১৫মে থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা যায় ২৬০ জন। এরমধ্যে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ ১২৬ জন, পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৯৩ জন, ডিবি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪৮ জন, নৌপুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’র ঘটনায় মারা যায় ৩ জন।
আসক এর নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজ গণমাধ্যমকে বলেন,‘সমস্যা হলো, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবছর বেশি দেখেছি; যদিও এর সঙ্গে মাদকবিরোধী আন্দোলনের সম্পৃক্ততা ছিল। জেনে না-জেনেও কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে আমরা যখন প্রতিবাদ করেছি, তখন কমেছে। কিন্তু দুঃখজনক, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আর স্বীকৃতি না দিলে কখনোই এসব ঘটনার বিচার হবে না।’
তিনি আরও বলেন,‘বাংলাদেশ অনেকগুলো সনদের সঙ্গে একমত হয়ে স্বাক্ষর করেছে, এটা খুব ভাল। সরকার ইউপিআর করেছে এবং অন্যান্য দেশের সুপারিশগুলো পালনের কথা বলেছে। এটাও ভাল দিক।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই ভয়াবহ। মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের দৃশ্যমান উদ্যোগের অভাব দেখছি।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘সমাজে অপরাধ থাকবে স্বাভাবিক এবং সেজন্যই আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন হয়। কিন্তু অভিযান পরিচালনার নামে তারা নিজ হাতে বিচারের দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কার। এগুলো তদন্ত হওয়া দরকার। আস্থাশীল একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে বিচার করা হোক। বিচারহীনতা বা ভয়ের সংস্কৃতিকে কোনও অবস্থতেই লালন করার সুযোগ নেই।’
গত বছরগুলোতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু সুশাসন ও মানবাধিককার প্রতিষ্ঠায় ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উন্নয়ন বিশেষ শ্রেণির সুবিধায় যাচ্ছে কিন্তু বৈষম্য কমেনি। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ, সুশাসন ও গণতন্ত্রের মাধ্যমে উন্নয়ন আসতে পারতো। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা থাকলে মানুষ নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রতিদিনের জীবনযাপন করতে পারতো।’
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র এটি স্বীকার করবে না। কারণ এটা রাষ্ট্রীয় পলিসিতেই গ্রহণ করা হয়েছে যে, এভাবে কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করতে হবে। ফলে তারা স্বীকার করার বিষয়টিই থাকে না।’
এদিকে জাতিসংঘ ঘোষিত ৬৮তম বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আজ সোমবার (১০ ডিসেম্বর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন (বিএইচআরসি) রাজধানী ঢাকা এবং সারাদেশে ও দেশের বাইরের শাখাগুলোয় দিবসটি একযোগে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জাতিসংঘের উদ্যোগে সদস্য দেশগুলোর সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরপর থেকেই বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশগুলো দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করে আসছে।