একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” তৈরী করতে ইসি বেশ কয়েকটি সংস্থাকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করবার অনুমতি দিয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১ অনুচ্ছেদের বিধানের আলোকে ইসি এই অনুমতি প্রদান করেছে।
এই অনুচ্ছেদে বলা আছে-
91C. (1) The Commission may permit in writing any person, whether national or foreign, as an election observer who is in no way associated with or affiliated to, any political party or contesting candidate and who is not known for his sympathy, direct or indirect, for any particular political ideology, creed or cause or for any manifesto, program, aims or object of any political party or contesting candidate.
অর্থাৎ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইসি চাইলে কোন দেশী বা বিদেশী ব্যক্তিকে (অথবা সংস্থাকে) নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে দ্বায়ীত্ব পালন করবার জন্য লিখিত অনুমতি দিতে পারে। তবে শর্ত থাকে যে, সেই ব্যক্তি (অথবা সংস্থা) (ক) কোনও রাজনৈতিক দল বা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর সাথে সংযুক্ত থাকতে পারবে না; (খ) কোনও রাজনৈতিক দল বা বা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর সাথে সম্পর্কিত হতে পারবে না; এবং (গ) কোনও রাজনৈতিক দল বা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর মতাদর্শ, বিশ্বাস, ভিত্তি, ম্যানিফেস্টো, প্রোগ্রাম, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত হতে পারবে না।
সম্প্রতি জনাব আদিলুর রহমান খান শুভ্রের সংগঠন “অধিকার” নির্বাচনের পর্যবেক্ষক হিসেবে ইসিতে নিবন্ধন হারায়। অভিযোগ রয়েছে যে, জনাব আদিলুর রহমান খান শুভ্র বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। জনাব আদিলুর রহমান খান শুভ্রের সংগঠন “অধিকার”, যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (অ্যানফ্রিল)-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি। একই সঙ্গে জনাব আদিলুর রহমান খান শুভ্র “অ্যানফ্রিল”-এর পরিচালক পর্যায়ের একজন সদস্য।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের “অ্যানফ্রিল”কে নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটা প্রকৃতপক্ষে “অধিকার”কেই দেওয়া হয়। যে প্রতিষ্ঠান ইসিতে নিবন্ধন হারানো সেটি অন্য দেশের প্রতিনিধিত্বের আড়ালে পর্যবেক্ষক হতে পারে না। আর তাই, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইসি সঠিক ভাবেই “অ্যানফ্রিল”কে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়নি।
পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এবারে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ৮১টি প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৯২০ জন পর্যবেক্ষককে ইসি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দিয়েছে (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮)। উপরের আইনের আলোকে আমরা জানি যে, একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে অবশ্যই নির্দলীয় হতে হবে। আর সেটা যদি না হয় তবে তারা ঘোলা পানিতে মাছ ধরবার চেষ্টা করবে। ‘দলকানা’ নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা কখনই নিরপেক্ষ মতামত দিবে না, দিতে পারে না; সে তার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়েই কথা বলবে বা মতামত দিবে। আর তাই ইসির উচিৎ হবে না কোন ‘দলকানা’ নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি দেয়া।
কিন্তু আমি ইসির অনুমতিপ্রাপ্ত নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ‘বিএনপি ঘনিষ্ঠ’ তিনটি পর্যবেক্ষক সংস্থা দেখতে পাচ্ছি। জানিনা এক্ষেত্রে ইসি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদের ব্যাত্যয় ঘটালো কিনা! এই তিনটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রত্যেকটি বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির সাথে সরাসরি ভাবে সংযুক্ত এবং সম্পর্কিত। আর শুধু তা-ই নয়, তিনটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির মতাদর্শ, বিশ্বাস, ভিত্তি, ম্যানিফেস্টো, প্রোগ্রাম, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের প্রতি প্রত্যক্ষভাবে সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত।
তিনটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার অন্যতম একটি হচ্ছে, “ডেমোক্রেসি ওয়াচ”। “ডেমোক্রেসি ওয়াচ”-এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন সাংবাদিক শফিক রেহমান এবং নির্বাহী পরিচালক মিসেস তালেয়া রহমান। দুজনে আবার স্বামী-স্ত্রী। সাংবাদিক শফিক রেহমান হচ্ছেন বিএনপির রাজনৈতিক দলের নেতা। তিনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা চেষ্টার মামলার আসামিও বটে। একসময় এই দম্পতির ঢাকার ইস্কাটনস্থ বাসভবন বিএনপির আগের “হাওয়া ভবন” হিসেবে পরিচিত ছিল। “ডেমোক্রেসি ওয়াচ”-এর মত বিএনপি “দলকানা” একটি সংগঠন যখন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাবে তখন তারা নানারকম সমস্যা সৃষ্টি করবে, তারা কিছুতেই নিরপেক্ষ মতামত দিবে না। সুতরাং, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “ডেমোক্রেসি ওয়াচ” কিছুতেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
আরেকটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হচ্ছে “আব্দুল মোমেন খান ফাউন্ডেশন” যা “খান ফাউন্ডেশন” নামেও পরিচিত। জনাব আব্দুল মোমেন খান অর্থাৎ যার নামে এই ফাউন্ডেশন, তিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরকারের খাদ্যমন্ত্রী। “খান ফাউন্ডেশন”-এর নির্বাহী পরিচালক হলেন মিসেস রোকসানা খন্দকার। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জনাব আবদুল মঈন খানের স্ত্রী এবং জনাব আব্দুল মোমেন খানের পুত্রবধু। তাহলে এটি দিনের আলোর মত পরিস্কার যে “খান ফাউন্ডেশন” নামক সংস্থাটির বিএনপি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় আছে। “খান ফাউন্ডেশন”-এর মত বিএনপি “দলকানা” একটি সংগঠন যখন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাবে তখন তারা কিছুতেই নিরপেক্ষ মতামত দিবে বলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না। অতএব, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “খান ফাউন্ডেশন” কিছুতেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
তিনটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার আরেকটি হচ্ছে, “লাইট হাউজ”। “লাইট হাউজ” বগুড়ায় নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছে। “লাইট হাউজ”-এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান। “লাইট হাউজ”-এর নির্বাহী পরিচালক হলেন জনাব হারুনুর রশীদ, যিনি বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী? “লাইট হাউজ” নামক সংস্থাটির বিএনপি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় আছে। “লাইট হাউজ”-এর মত বিএনপি “দলকানা” একটি সংগঠন যখন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাবে তখন তারাও কিছুতেই নিরপেক্ষ মতামত দিবে বলে মনে করিনা। ফলে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “লাইট হাউজ” কিছুতেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
অথচ ইসি “ডেমোক্রেসি ওয়াচ”, “খান ফাউন্ডেশন” এবং “লাইট হাউজ”-এই তিনটি সংস্থাকেই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করবার অনুমতি দিয়েছে। যুক্তি হিসেবে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমে বলেছেন, “এই সংস্থাগুলো ইসিতে নিবন্ধিত। আইনগতভাবে নিবন্ধন বাতিল করা জটিল প্রক্রিয়া। যেহেতু তারা ইসিতে নিবন্ধিত, তাই তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত রাখা যাবে না।’’
কি জানি বাবা! কিছুই তো বুঝলাম না। আইন বড়, না নিবন্ধন বড়? যেহেতু এই তিনটি সংস্থারই (“ডেমোক্রেসি ওয়াচ”, “খান ফাউন্ডেশন” এবং “লাইট হাউজ”) বিএনপির মত রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, সেহেতু আইন (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১সি(১) অনুচ্ছেদ) ভঙ্গ করে নিবন্ধন করাটাই তো প্রথম অন্যায়। আর তার উপরে আইন ভঙ্গ করে এসব নিবন্ধিত ‘‘দলকানা’’ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে “সিন্দাবাদের ভুতের” মত পিঠে চড়িয়ে পক্ষপাতমূলক নির্বাচন-এর দায়ভার তো জাতিকেই বইতে হবে। ইসি কি সেই দায়ভারের বাইরে থাকতে পারবে? কখনই না! নাগরিক হিসেবে আমাদের একটাই দাবী, সামনের নির্বাচনে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক চাই, কোন কূচক্রী–দালাল নয়!
লেখক : আইনের শিক্ষক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী