অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন :
যৌন হেনস্তা, নিপীড়ন একটি ঘৃণ্য,অমানবিক ও কুরুচিপূর্ণ গর্হিত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সমাজে নারী পুরুষের অসমতা ও আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ এই যৌন নিপীড়ন। নারী নির্যাতন রোধকল্পে বাংলাদেশে অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু সেই অর্থে যৌন অত্যাচারের অভিযোগ কমেনি বরং বেড়েছে! এর প্রধান কারণ হলো নারী ও পুরুষকে এককভাবে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করা। নারীর অধিকার বাস্তবায়ন করতে হলে মানবাধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে আগে।
পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা বিবেচিত হয় অবলা, দুর্বল ও অসহায় হিসেবে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের মাইন্ডসেট হলো দুর্বলকে সাপোর্ট করা, প্রভাবশালী কেউ বিপদে পড়লে হাত তালি দেয়া। কিন্তু মি টু আন্দোলনের সব ঘটনার ক্ষেত্রে শুধু নারীদের সাপোর্ট করার ব্যাপারটি কেবল তাদের অধিকারকে মেনে নেয়া নয়; বরং সাধারণ ট্রেন্ড হিসেবে তাদেরকে দুর্বল মনে করে পাশে থাকার ভন্ডচেষ্টা যা আদতে নারীদের পরোক্ষভাবে অসম্মানই করে বটে। আপনি যখন ন্যায়বিচারের দাবী তুলবেন তখন আপনাকে শুরু থেকেই নিরপেক্ষতা বজায় রেখে রাগ, অনুরাগের উর্ধ্বে উঠে বিবেচনা করতে হবে।ন্যায়বিচার চাওয়া ও পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো নিরপেক্ষতা। আপনার আগে থেকেই মীমাংসিত মতামত ন্যায়বিচারের অন্তরায়।
“#মি টু ” আন্দোলনের আতুরঘর হলো আমেরিকার শোবিজ পাড়ায়। এ পর্যন্ত “#মি টু” আন্দোলনের শিকার ও শিকারী দুই পক্ষই আন্তর্জাতিক মানের ব্যক্তিবর্গ যারা পেশা জীবনে নিজস্ব ক্যারিশমা, মেধা শ্রম দিয়ে নিজেদের এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। কিছুদিন আগে প্রখ্যাত কলামিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক আলী রীয়াজের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠলে তিনি তা সর্বেব মিথ্যা ও সুনাম নষ্টের চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু অনেককেই তাকে নিয়ে টিটকারি করতে দেখেছি। তাহলে কি সবাই ধরেই নিয়েছে যে সে নিপীড়ক? তাহলে তাঁর সেল্ফডিফেন্সের পথ কই?
এমন হঠাৎ ঝড় এসে যখন তাদের যুগ যুগ ধরে তৈরি করা সাজানো বাগান তছনছ করে দিচ্ছে তখন তাদের পক্ষ থেকে ঘটনার সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের আকুতি আপনি প্রত্যাখ্যান করলে; আপনি কারো পক্ষপাতী হয়ে গেলেন এবং ন্যায়বিচারের মূলনীতি থেকে সরে গেলেন!
অভিযুক্তকে অবশ্যই সুযোগ দিতে হবে। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২, ৬, ৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে নারী-পুরুষের সমতা ও সমান আইনি সুরক্ষা ও সেবা পাবার অধিকারের কথা উঠে এসেছে। এবং বাংলাদেশের আইনেও বিষয়টি স্বীকৃত।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।”
পাশাপাশি অনুচ্ছেদ ২৮ (১) এ উল্লেখ আছে, ” কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। ”
অপরাধ প্রমাণিত হবার আগে যেহেতু কাউকে অপরাধী বলা যাবে না, তাহলে বিখ্যাত কারো বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ উঠলে বিনা যাচাইয়ে তা ভাইরাল করে দিলে সেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত,পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের যে ক্ষতি হয় তার প্রতিকার কী?
আইনের চোখে নারী-পুরুষ সমান। আইন সবাইকে ন্যায় বিচারের ওয়াদা দেয় ও সমান সুরক্ষা দেয়ায়অংগীকারবদ্ধ।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৮ ধারায় জেন্ডারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ইংরেজি ” He ” এর অর্থ নারী ও পুরুষ উভয়কেই নির্দেশ করবে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সমাজে নারী পুরুষ বিভেদ না করে সবাইকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সর্বজনীন মানবাধিকার বাস্তবায়ন হলে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যাবে তখন নারীর জন্যেও রাজপথ নিরাপদ হবে,অফিস হবে শান্তিময়,বাসাবাড়িতে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাবে। তা নাহলে দুই পক্ষই একে অন্যকে সহযোগী না ভেবে প্রতিযোগিতার মনোভাব পোষণ করবে যা সমাজিক অগ্রগতি পিছিয়ে দেবে।
বিকল্প প্রতিকার কী হতে পারে?
ফৌজদারী অপরাধের বিচার চাওয়ার মেয়াদ কখনো তামাদি হয় না। তবে দীর্ঘদিন পর অভিযোগ নিয়ে এলে সেটা অভিযোক্তারবিশ্বাসযোগ্যতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাপ্রশ্নবিদ্ধ করে। যে নারীরা তাদের প্রয়োজনের সময় তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া সকল অন্যায়কে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে সেসবকেপুঁজি করে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করে নিলো; বহুবছর পর তাঁকে লাইমলাইটে আসতে সাহায্যকারী লোকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা আসলে নৈতিকতার দিক থেকে বিবেচনায় একটা আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে; ফলে সাধারণ নারীদের উপর এর বিরুপ প্রভাব পরে। নারীদের দ্বারা মিথ্যা মামলার শিকার হবার উদাহরণ আদালতে ভুরিভুরি পাওয়া যায়। কিছু দিন আগে প্রথম আলোর অনুসসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে নারী নির্যাতনের মামালায় প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। যার অন্যতম কারণ হলো কারনেঅকারণে মিথ্যা মামলা রুজু করা।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন,২০০০ এর ১৭ (১) ধারায় আছে, ” যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোন ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান তাহা হইলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করাইয়াছেন উক্ত ব্যক্তি অনধিক সাত বত্সর সশ্রমকারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷ ” এবং আমাদের দণ্ডবিধিতেও মিথ্যা মামলা রুজু করা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা রুজু করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে যাতে নিরপরাধ মানুষজন হয়রানির শিকার হলেও প্রতিকার পান। কিছু সুযোগসন্ধানী নারীদের খামখেয়ালি আইন প্রয়োগের ফলে অনেক সত্যিকারভিক্টিম নারীরা তাদের আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের শিকার হোন।
এক্ষেত্রে ” #InstantAction ” আন্দোলনকে জনপ্রিয় করলে চতুর্দিকে একযোগে প্রতিবাদের ঝড় উঠতো। অর্থাৎ তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ করলে সবার সমর্থনে নিপীড়কদেরবিরুদ্ধে একটি জোরালো সামাজিক আন্দোলন হত ফলে শিকার ও শিকারী উভয়ের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যেত।
যৌনসন্ত্রাস মোকাবিলা করতে সমাজের নারী ও সচেতন পুরুষদের ” #InstantAction ” ক্যাম্পেইনকে আন্দোলনে রূপ দেয়ারআহব্বান জানাই।
লেখক : আইনজীবী ও সমাজকর্মী; ই-মেইল : bellal.sincere@gmail.com