ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ :
জাতিসংঘের মতে, আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা। বছরের পর বছর ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ রক্ষার নামে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার রাষ্ট্র যে নির্মম নিপীড়ন চালিয়ে আসছে তার থেকে চোখ ফিরিয়ে বিশ্ব শান্তির কথা বলা, এমনকি চিন্তা করাও নিতান্ত হাস্যকর। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে নির্মম নিপীড়ন চালানো হয়েছে তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। অথচ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জাতিসংঘ নিজে, জাতি রাষ্ট্রগুলো, এমনকি আন্তর্জাতিক সুধীসমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিপীড়নের ব্যাপারটিকে শুধু ‘Ethnic Cleansing’ বা ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বলেই ক্ষান্ত। বিচার-আচারের আশপাশ দিয়েও কেউ যাচ্ছে না। আর যাবেই বা কী করে? আন্তর্জাতিক আইনে ‘Ethnic Cleansing’ বা ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের’ কোনো আইনগত ভিত্তিই নেই- আবার তার বিচার!
২০১৭ সালের ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়ার আইন অনুষদে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নবিষয়ক ‘Permanent People’s’-এর অধিবেশন বসে। এই ট্রাইব্যুনাল রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের কারণে মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘Ethnic Cleansing is an oblique expression’ অর্থাৎ ‘Ethnic Cleansing’ বা ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হলো একটি অস্পষ্ট ধারণা। পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, “..the expression‘Ethnic Cleansing’ has no formal status in international law” অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বিষয়টির কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অতএব, যত দিন আমরা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে চিহ্নিত করব তত দিন পর্যন্ত আমরা আন্তর্জাতিক আইনে এর কোনো আইনি বা বিচারিক প্রতিকার পাব না।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে ধরনের নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে Genocide বা গণহত্যার শামিল। বহু আগে থেকেই আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ। ১৯৪৮ সালের Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide. সাধারণভাবে ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ নামে পরিচিত। এই কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ‘জেনোসাইড’কে প্রথমবারের মতো সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, জেনোসাইড কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে জেনোসাইডকে একটি বিচারযোগ্য ও দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালের Rome Statuehv দ্বারা আইসিসি গঠন করা হয়েছে, সেখানেও জেনোসাইডের একই সংজ্ঞা গ্রহণ করে তাকে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ এবং জেনোসাইড বা গণহত্যার মধ্যে পার্থক্য কী? ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ নিয়ে জাতিসংঘের ১৯৯৩ সালের একটি সংজ্ঞা রয়েছে। সংজ্ঞাটি অনুযায়ী ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের’ মানে হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট ভ‚খণ্ডে শুধু একই রকম গোষ্ঠীর (Homogeneous group) বসবাসযোগ্য করার লক্ষ্যে ওই ভ‚খণ্ড থেকে অন্য সব গোষ্ঠীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক বিতাড়িত করা। অন্যদিকে জেনোসাইড কনভেনশন এবং Rome Statue অনুযায়ী জেনোসাইড হলো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তাদের ওপর নানা রকম নিপীড়ন চালানো। এখানে উল্লেখ্য যে, জেনোসাইড প্রমাণ করার জন্য হত্যা প্রমাণ করা জরুরি নয়, হত্যা না করেও কোনো গোষ্ঠীকে যদি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়, তবু জেনোসাইড হতে পারে। মোদ্দা কথা, জাতিগত নিধনযজ্ঞের উদ্দেশ্য হলো কোনো একটি জাতিকে একটি ভ‚খণ্ড থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বা জোরপূর্বক বিতাড়িত করা। আর অন্যদিকে জেনোসাইডের উদ্দেশ্য হলো ওই নির্দিষ্ট জাতির ওপর নানারকম নিপীড়ন চালিয়ে তাকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা।
আন্তর্জাতিক আইনে যেহেতু জাতিগত নিধনযজ্ঞকে কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে এখনো চিহ্নিত করা হয়নি, তাই একটি প্রকৃত জেনোসাইডকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে দাবি করা মানে হলো জেনোসাইড অপরাধকে আইনের চোখে ভিন্ন খাতে পরিবাহিত করার কুপ্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে অপরাধীর সংঘটিত অপরাধের ভয়াবহতাকে কম করে দেখানোর নগ্ন প্রয়াস চালানোর প্রচেষ্টা করা হয়। এমনটি আগেও ঘটেছে বৈকি। সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্নোবোদান মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে যুগোস্লোভিয়ার ট্রাইবুন্যাল,International Criminal Tribunal for the Former Yugoslavia (ICTy) জেনোসাইডের অভিযোগ আনা হলে মামলার শুনানিতে মিলোসেভিচের আইনজীবীরা খুব সুচতুরভাবে ‘জেনোসাইড’ শব্দটিকে এড়িয়ে গিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করে। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে মিলোসেভিচের অপরাধ প্রমাণিত হলেও তাঁর অপরাধ ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বিবেচ্য না হয়ে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে বিবেচ্য হলে হয়তো তার দণ্ড অপেক্ষাকৃতভাবে কম হতে পারে। তবে যেহেতু মামলা চলাকালে মিলোসেভিচের অকালমৃত্যু ঘটে, তাই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বা সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণ আর পাওয়া যায়নি।
তবে এখন উদ্ভ‚ত রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যার কারণ অনুসন্ধানে বা আইনি পদক্ষেপের ক্ষেত্রে আমাদের সাবধানী হতে হবে। কোনোভাবেই যেন আমরা রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যাটিকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে বিবেচনা না করি। এটি একটি ‘জেনোসাইড’, এই সত্য আমাদের আইনগতভাবে যেমন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তেমনি এ ব্যাপারে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতাও চালাতে হবে।
রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যার কারণ ও বর্তমান পরিস্থিতি অনুসন্ধানে জাতিসংঘের বিশেষ দূত মিস ইয়াংঘি লি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২০-২৩ তারিখে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন শেষে UN Office of the High Commissioner for Human Rights (UNOHCHR) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে মিয়ানমারে যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে চলেছে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
UNOHCHR-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেখানকার সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও তাদের মদদপ্রাপ্ত উন্মত্ত জনতা নির্দ্বিধায় ব্যাপকভাবে গণধর্ষণ, শিশু হত্যা, নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন, গুম ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। ইয়াংঘি লি যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের বেশিরভাগই স্বচক্ষে নিজ পরিবারের সদস্যদের নিহত হতে দেখেছে। অনেকের পরিবারের সদস্যরা এখনো উধাও রয়েছে। শিশুদের, এমনকি যাদের বয়স আট বছর, পাঁচ বছর অথবা মাত্র আট মাস, তাদেরও জবাই করে মেরে ফেলা হচ্ছে।
UNOHCHR-এর প্রতিবেদনে আরো জানা যায় যে ইয়াংঘি লি তার পরিদর্শনের সময় মোট ১০১ জন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশি দাবি করে, তারা মিয়ানমারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং বিভিন্ন প্রকারের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
UNOHCHR-এর প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের বাড়িঘর, স্কুল, হাট-বাজার, দোকান, মাদ্রাসা এবং মসজিদ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তাদের খাদ্যশস্য, ক্ষেত-খামার ও গবাদি পশুগুলো লুট করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের বাসস্থান এবং দেশ থেকে জবরদস্তি বিতাড়ন করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায় অনুযায়ী, মিয়ানমারের সেনা সদস্য, পুলিশ ও তাদের মদদপ্রাপ্ত জনগণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা প্রকার ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করছে। এই গণ-আদালতে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার বিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা রকম তথ্য-উপাত্ত, এমনকি ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে জবানবন্দিও লিপিবদ্ধ করা হয়। আগেই বলেছি, এ সব কিছুর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক গণ-আদালত মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে তার রায় ঘোষণা করেন।
বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছে নির্মম অভিজ্ঞতার ঝুলি। তারা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। আমাদের দেশি ও বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন, গবেষণা সংস্থা, গণমাধ্যমকর্মীরা নিয়মিতভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছেন।
সবকিছু থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যা হয়েছে বা হচ্ছে, তাকে শুধু ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বললে কম বলা হবে বা ভুল বলা হবে। আইনের চুলচেরা বিচারে এটি একটি ‘জেনোসাইড’, আর এটাই সত্য।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক