চেহারার মিল থাকায় জাহালম বিনা দোষে কারাগারে ছিলেন তিনটি বছর। এবার আরেক ‘জাহালমের’ খোঁজ মিলেছে। তিনি শুক্কুর শাহ। নামের মিল থাকায় এবার তাঁকে এক বছর জেল খাটতে হয়েছে। আসল আসামির নাম শুক্কুর আলী। আদালতের কাছে মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) এই ভুল স্বীকার করেছে পুলিশ।
পুলিশ ভুল স্বীকার করায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-২ গতকাল মঙ্গলবার শুক্কুর শাহকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারাগার সূত্র বলছে, রাতেই শুক্কুর শাহ কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। শুক্কুর শাহের আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশের ভুলের কারণে শুক্কুর শাহ এক বছর ধরে বিনা দোষে জেল খাটল।’
রাজধানীর হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, নামের মিল থাকায় ভুল আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁরা এই ভুল করেননি। এ জন্য তাঁরা আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
প্রকৃত আসামি শুক্কুর আলীর বাড়ি হাজারীবাগে। মামলার কাগজপত্রে দেখা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়ার সময় শুক্কুর আলীর বয়স ছিল ৩৭ বছর। বাবার নাম আবুল কাশেম (মৃত)। মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে তাঁর একটাই ঠিকানা (১৯৫/২ হাজারীবাগ রোড) দেওয়া।
অন্যদিকে, অকারণে জেল খাটা শুক্কুর শাহ যখন গ্রেপ্তার হন, তখন পুলিশ তাঁর বয়স উল্লেখ করে ৩০ বছর। মাদকের ভিন্ন একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের তিন মাসের মাথায় তিনি জামিনও পেয়ে যান। শুক্কুর শাহের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝড়ার নাগরবাড়ী গ্রামে। তাঁর বাবার নামও আবুল কাশেম। তবে তিনি মৃত নন, জীবিত। ওই মামলায় শুক্কুর শাহের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া ১৫৯/১ সুলতানগঞ্জ, মধুবাজার, হাজারীবাগ।
শুক্কুর শাহের বাবা আবুল কাশেম গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকার রায়ের বাজার এলাকায় তাঁর ছেলের লন্ড্রির দোকান ছিল। তিনি বলেন, ‘যাদের ভুলে আমার ছেলে এক বছর ধরে জেল খাটল, তাদের শাস্তি চাই।’
পুলিশের ভুলের শুরু যেভাবে
আদালত সূত্রে জানা গেছে, শুক্কুর আলী নামের এক ব্যক্তিকে শাহবাগ থানার মাদক মামলায় ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তদন্ত করে পরের মাসে শুক্কুর আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ২০১১ সালের ১১ মে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২-এ পাঠানো হয়। প্রকৃত আসামি শুক্কুর আলীর উপস্থিতিতে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন করেন আদালত। শুরু হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম।
আদালত সূত্রে জানা যাচ্ছে, হাজারীবাগের বাসিন্দা শুক্কুরকে ২০১২ সালের ২৭ মে পর্যন্ত আটবার আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু কোনো সাক্ষী আনতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১২ সালের ২০ জুন জামিন চান শুক্কুর আলী। আদালত সেদিন শুক্কুর আলীকে জামিন দেন। তিনি জামিনে বেরিয়ে মাত্র দুবার আদালতে হাজির হন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে পলাতক শুক্কুর আলী। আদালত ওই বছরের ৩ এপ্রিল শুক্কুর আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা তামিল করতে বলা হয় হাজারীবাগ থানাকে। তখন থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শুক্কুর আলী গ্রেপ্তার হননি। তবে ২০১৮ সালের ৪ মার্চ হাজারীবাগ থানার এসআই আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে বলেন, তিনি তদন্ত করে জানতে পেরেছেন, শুক্কুর আলী হাজারীবাগ থানার আরেকটি মাদক মামলায় (মামলা নম্বর ৯(৩)১৮) ৩ মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তাঁকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হোক।
পুলিশের আবেদন পাওয়ার পর শুক্কুর আলীকে হাজির করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।
শুক্কুর আলী নাকি শুক্কুর শাহ?
শুক্কুর শাহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাদকের ভিন্ন এক মামলায়। গ্রেপ্তারের তিন মাসের মাথায় তিনি জামিনও পেয়ে যান বলে জানান তাঁর আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন। শুক্কুর শাহকে পুলিশ অন্য আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর পর, গত বছরের ৮ মার্চ মেজবাহ উদ্দিন আদালতে আবেদন করে বলেন, পুলিশ যাঁকে শুক্কুর আলী বলে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে, তিনি আদতে শুক্কুর শাহ। এই মামলার আসামি তিনি নন। আদালত শুক্কুর শাহের আবেদন পেয়ে এ ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য হাজারীবাগ থানার ওসি ও ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জেল কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৩ অক্টোবর আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে জানায়, আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আসামি বলেছেন, তিনি শুক্কুর আলী নন।
গত বছরের ৪ অক্টোবরে দেওয়া আদেশে আদালত বলেন, জেল কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে আসামির পরিচয় সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। হাজারীবাগ থানা যে আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেছে, তিনিই শুক্কুর আলী। আদালতের আদেশে লেখা, ‘গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মো. শুক্কুর আলী মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।’ সেদিনই শুক্কুর শাহ জামিন পান শুক্কুর আলী হিসেবে।
অর্থাৎ যে আসামি নিজেকে শুক্কুর শাহ বলে দাবি করছেন, আদালতের কাছে তিনি হয়ে যান শুক্কুর আলী। এই নামেই তাঁর জামিন মেলে। যদিও তাঁর দাবি, তিনি শুক্কুর আলী নন, শুক্কুর শাহ।
জামিন পেয়েও মুক্তি মেলে না
আদালতের আদেশে জামিন দেওয়া হয় শুক্কুর আলীকে। কিন্তু যাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, জেল কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি শুক্কুর শাহ নামেই নথিবদ্ধ। তাই শুক্কুর আলীর নামে শুক্কুর শাহ জামিন পেয়ে গেলেও তাঁর মুক্তি মেলে না।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, জামিন দেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় জেল কর্তৃপক্ষ আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলে, এ মামলায় শুক্কুর আলী নামের কোনো আসামি কারাগারে নেই। যে আসামি কারাগারে আছেন, তাঁর নাম শুক্কুর শাহ। জেল কর্তৃপক্ষের এমন প্রতিবেদন পেয়ে আদালত তখন হাজারীবাগ থানার ওসি ও এসআই মমিনুল হককে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
কিন্তু এবারও শুক্কুর শাহকে শুক্কুর আলী বলেই অভিহিত করে পুলিশ। হাজারীবাগ থানার এসআই মমিনুল গত ২০ নভেম্বর ফের আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে জানান, এ আসামি শুক্কুর আলী। নিজেকে কখনো শুক্কুর শাহ বলে পরিচয় দিতেন। এ আসামি শুক্কুর আলী।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, তখন জেল কর্তৃপক্ষ ফের আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, এ মামলায় শুক্কুর আলী নামের কোনো আসামি নেই।
যেভাবে নিজের পরিচয় ফিরে পেলেন শুক্কুর শাহ
শুক্কুর আলী যে মামলার আসামি, সেই মামলার বাদী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পুলিশ পরিদর্শক মোফাজ্জল হোসেন চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে হাজির হন। আসামির কাঠগড়ায় আসামিকে দেখে তিনি বলেন, ‘এ আসামিকে তিনি গ্রেপ্তার করেননি।’
আদালত তখন আদেশে বলেন, পুলিশ ও কারাগারের প্রতিবেদন এক নয়। আদালত জেল সুপার এবং হাজারীবাগ থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া ও এসআই মমিনুলকে মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার জেল সুপার এবং হাজারীবাগ থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া ও এসআই মমিনুল আদালতে হাজির হন। জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী মামলার প্রকৃত আসামি শুক্কুর আলীর ছবিসহ প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মামলার আসামি শুক্কুর আলী জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
মঙ্গলবার এসআই মমিনুল হক ভুল স্বীকার করে বলেন, শুক্কুর আলী ও শুক্কুর শাহ এক ব্যক্তি নন। শুক্কুর শাহকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে তিনি ভুল করেছেন। একই কথা বলেন হাজারীবাগ থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া।
হাজারীবাগ থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, দুজন আসামির নাম শুক্কুর। বাবার নামও এক। এ কারণেই ভুল হয়েছে। তবে এটি ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।
এই মামলায় আদালতের সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে আছেন ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ। প্রকৃত আসামি শুক্কুর আলী ও শুক্কুর শাহকে কেন চেহারায় আলাদা করা গেল না, তা জানতে চাইলে ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রকৃত আসামি শুক্কুর আলীকে দেখলেও খেয়াল নেই। কত আসামি আসছেন–যাচ্ছেন আমার খেয়াল নেই।’
তিনি বলেন, শুক্কুর শাহকে শুক্কুর আলী বানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ আদালতে ক্ষমা চেয়েছে। এমন ভুল হবে না বলে অঙ্গীকারও করেছে। প্রথম আলো