স্ত্রী উদ্ধারে স্বামীর রিট খারিজ
সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ

মাতৃভাষায় আদালতের রায় : পর্ব-২

বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল : 

বাংলা ভাষা প্রচলনসংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫ পাঠে এটা সুস্পষ্ট যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি প্রচ- ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত হয়েছিলেন, যখন তিনি জানতে পারলেন এদেশের লোকেরাই কীভাবে এদেশের নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে তথা সংবিধান ভঙ্গ করে বিজাতীয় পরভাষা ইংরেজিতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি তাদের উচ্ছৃঙ্খল বলেছেন। তিনি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন, পরিশেষে তিনি তাদের শাস্তির নির্দেশও প্রদান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যদি জাতির জনক বেঁচে থাকতেন তাহলে বহু আগেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করতেন।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ১ মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমাদের পবিত্র সংবিধানে আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ আর প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালতই এই প্রজাতন্ত্রের আদালত।’

কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০ খ্রিষ্টাব্দ-১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দ) তার কবিতায় বলেছেন যে,

‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’

ভাষাসৈনিক এবং একুশে আন্দোলনের শীর্ষ নেতা আব্দুল মতিন বলেছেন যে, ‘আইনের সর্বক্ষেত্রে আমরা বাংলাকে প্রয়োগ করতে পারি এবং আমি দু’ একটি লোয়ার কোর্টের রায়ে দেখেছি, বাংলায় যখন রায় হয় তখন বেশ বুঝতে পারা যায় বরং ইংরেজি ভাষায় রায় দেওয়া হলে অনেক সময় বুঝতে পারা যায় না। এত জটিল ভাষা এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, তার নিরিখে করা কঠিন হয়ে পড়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য। তো, এখন আমরা কোথায় যাব? বহু সাধনা, বহু রক্তের বিনিময়ে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা অর্জন করেছি, আমরা যেন একে রক্ষা করতে পারি। যে যত বিরোধিতা করুক, যে যতই কষ্ট করুক এর অবমাননা হতে দেওয়া যায় না।’ (বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা, পাতা-৩৩)।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় আইনচর্চার পথিকৃৎ গাজী শামছুর রহমান বলেছেন যে, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা, তা সংবিধান বলে দিয়েছে। সংবিধান বলেনি যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে, ভবিষ্যৎব্যঞ্জক কোন উক্তি সংবিধানে নেই। সুতরাং বাংলা ভাষা আইনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে কিনা, সে প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েই আছে।

আইনের পরিভাষার মূল সাহিত্য বা রম্য রচনার তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক পারিভাষিক শব্দকে সাধারণভাবে আইনের ক্ষেত্রে একটিমাত্র অর্থ বহন করতে হয়।

আইন বিষয়ে অনেক বই রচনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। চারটি ছাড়া অন্য সবগুলো বই বাংলাতে লেখা। এই কাজ করতে গিয়ে আমার নিশ্চিত প্রতীতি জন্মেছে যে বাংলা ভাষার শক্তি এবং যোগ্যতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ মূর্খতারই নামান্তর। পরাধীনতাজনিত হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারলে এই সংশয় আর থাকে না। তদুপরি একখানি পরিভাষা টেবিলে থাকলে ভাষান্তরকালে সাময়িক অসুবিধা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

দেশের আইন এখনো ইংরেজি ভাষার নিগড়ে আবদ্ধ। ঐ নিগড় ভেঙে আইনকে মুক্তি দিতে হবে।’ (বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা পাতা-৯৭)।

ভাষাসৈনিক ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট গাজীউল হক বলেছেন যে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক-এর মা একদিন জানতে চেয়েছিলেন আমি হাইকোর্টে যে আইন ব্যবসা করি তাতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করি কি না? ভাষাসৈনিক সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের একজন হয়ে মিথ্যে বলতে পারিনি। বললাম, আমরা এখনো হাইকোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে বাংলা ভাষায় আরজি বা জবাব লিখি না, সওয়াল জবাব করি না। এরপর ভাষা শহীদ রফিকের মা রফিজা খানমের মৃদু কথাটি তিরস্কারের মতো আমার কানে বাজল। ছোট্ট করে কথাটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, তাহলে রফিকেরা প্রাণ দিলে কেন? আর কোন কথা না বলে মা ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আমার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে শহীদ মিনার থেকে নেমে এসেছিলেন। মায়ের সেই ছোট্ট স্বাগতোক্তি আমাকে ভীষণভাবে লজ্জা দিয়েছিল। বলেছিলাম এরপরে বাংলায় লিখব। তারপর থেকেই বাংলা ভাষায় হাইকোর্টের দেওয়ানি, ফৌজদারি রিট মামলার আমি জবাব লেখা শুরু করলাম। এই ব্যাপারে সাহায্য করলেন আমার প্রিয় সহকর্মী আইনজীবীগণ সর্ব অ্যাডভোকেট ওজায়ের ফারুক, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, মাহবুব শামসুদ্দীন বাবুল, জাফর, রুহুল আমীন ভূঁইয়া। এরা সকলেই বিচারপতিদের মধ্যেও জনাব আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব নাঈম উদ্দিন আহম্মদ প্রভৃতি বিচারপতিগণ বাংলায় আদেশ দান এবং রায় লেখা শুরু করলেন। (বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা’ পাতা-১০২)

বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা’ বইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন যে, “ন্যায়বিচার যদি সদগুণ হয় এবং জনগণের কল্যাণের জন্যই যদি এর কাজ হয়, তবে তা জনগণের ভাষাতেই হওয়া উচিত। আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা মাতৃভাষার মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি বোঝা, শেখা বা শেখানা যায়, তা পরভাষায় সম্ভব নয়। আমাদের ভাষায় পারঙ্গমতা সম্পর্কে আমরা অহেতুক সন্দিহান। দেশের আদালতে যে দ্বৈতশাসন চলছে নিচের আদালতে বাংলা এবং ওপরের আদালতে ইংরেজি তার আশু অবসান হওয়া প্রয়োজন।

যে-ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধানের মতো একটি জটিল বিষয় বিবেচনা করা সম্ভব হয়েছে, হেন মানবিক সমস্যা নেই, যার ওপর সেই ভাষায় কোন সহজ সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। পরভাষার আইনচর্চার ফলে আমরা যেমন আইনশাস্ত্রে স্বাভাবিক সহজতা লাভ করিনি, তেমন কোনো মৌলিক অবদানও রাখতে পারিনি।

আইন ও বিচার তো দেশের লোকের জন্য। বিদেশিদের সুবিধা-অসুবিধা গৌণ ব্যাপার। দেশের রায় বাংলায় লিখতে হবে, যাতে নিরক্ষরও শুনলে কিছু বুঝতে পারে। বিদেশিদের অসুবিধা এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সব সন্দেহ নিরসনকল্পে সংসদের দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া উচিত। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে আদালতে সহজে প্রবেশাধিকার পায়, সে কথা ভেবে ইংল্যান্ডে লর্ড উলফ তাঁর অ্যাকসেস টু জাস্টিস-এ অবোধ্য ও স্বল্পব্যবহৃত লাতিন শব্দ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন। ‘আমরা কি যাব না তাদের কাছে, যারা শুধু বাংলায় কথা বলে?’ এই আর্ত প্রশ্ন আমরা অনেকবার করেছি। আমরা উত্তর পাইনি।
অনেকের ধারণা, বাংলায় লেখা হলে আমাদের রায় কেউ পড়বে না। আমাদের রায় পড়ার জন্য যেন সারা বিশ্ব রাত জেগে বসে আছে! যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের স্বার্থ জড়িত এবং বাণিজ্যেক সম্পর্ক, সেসব দেশের বেশ কিছু লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশের ল জার্নাল বা বই নেই বললেই চলে।

যাঁরা ফিয়ের জন্য হুজ্জুতে অজুহাত দিতে পারদর্শী, তাঁরা বলেন, সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি, সব ধরনের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ বাংলায় করতে হবে। ইংরেজি ব্যবহার সংবিধান পরিপন্থী হবে না। সংবিধান ইংরেজিকে বাদ দেয়নি, বরং ইংরেজি টেক্সটের বিধান করে দিয়ে ইংরেজিকে গ্রহণ করেছে, ইংরেজিকে একটি ভাষার মাধ্যম হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে। তাঁরা এমন কথাও বলেন যে, স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরে অন্যন্যোপায় হয়ে শিল্পের জাতীয়করণ করে আমাদের অব্যবস্থা ও দুর্গতি হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমাদের অনুরূপ দুর্গতি ঘটবে। তাঁদের ধারণা, অশুভবুদ্ধির প্রণোদনায় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নতুন এক ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে।

আইন ও বিচার তো দেশের লোকের জন্য। বিদেশিদের সুবিধা-অসুবিধা গৌণ ব্যাপার। দেশের রায় বাংলায় লিখতে হবে, যাতে নিরক্ষরও শুনলে কিছু বুঝতে পারে। বিদেশিদের অসুবিধা এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সব সন্দেহ নিরসনকল্পে সংসদের দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

আদালত……..সম্মানিত বিচারকগণও বাঙালি, বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বাঙালি এবং বিচারপ্রার্থীগণও ব্যতিক্রম সবাই বাঙালি। সকল আদালত কর্তৃক ঘোষিত রায় বাংলা ভাষায় হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। মুষ্টিমেয় লোকের জন্য এই বিচারব্যবস্থা নয়। এই বিচারব্যবস্থা দেশের সব মানুষের সর্বস্তরের আদালতের সম্মানিত বিচারকগণ নিজের মাতৃভাষায় যেন নিপুণভাবে রায় লিখতে পারেন, এই বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করবে বলে জনগণ আশা করে। প্রধানমন্ত্রীর ভালো করে জানার কথা, জনগণের আশা প্রায়ই পূরণ হয় না। এখন জনগণের প্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশনা না দিলে জনগণের নিজের ভাষায় রায় শোনার সৌভাগ্য হবে না।………

ভাষার দৈন্যমোচন এবং বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর সমকক্ষ করে তোলা আমাদের বড় দায়। সেই দায়মোচনে পরিশ্রমবিমুখ না হয়ে নিজেদের একাগ্রচিত্তে নিবেদন করবে সে হবে আমাদের জন্য মঙ্গলময় ও কল্যাণকর।……

বহুনিন্দিত দ্বিজাতিতত্ত্ব ধ্বংসের বদৌলতে, বাংলা ভাষায় গুণে, সোনার বাংলার সৌভাগ্যে এবং ইতিহাসের দুর্জ্ঞেয় গূঢ় লীলায় বাংলাদেশ আজ এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যাঁরা বলেন, ভারতের উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, তাঁদের জন্য উচিত, ভারত ইংরেজির পথে যে যাত্রা করেছিল, সে ছিল তার জন্য অগস্ত্যযাত্রা। আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের একমাত্র যোগসূত্র ইংরেজী, যা ছিন্ন হলে বহুজাতির দেশ ভারত ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা সেভাবে দুর্ভাবনাগ্রস্ত নই। আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের নিজের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিজের ভাষায় রাষ্ট্রের অন্যতম সার্বভৌম ক্ষমতা বিচারকার্য সমাধান করার সুযোগ পেয়েছি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন সত্ত্বেও আমরা এ দেশটিকে সুযোগ হারানোর দেশ হিসেবে নষ্ট করার জন্য বদ্ধপরিকর।……..

উচ্চ আদলতে রাষ্ট্রভাষার সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে তার প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের আগে ভাবতে হবে। দেশের আদালতে যে দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সে তো এক লজ্জাকর ব্যাপার। এ দুর্গতি যত তাড়াতাড়ি দূর হয়, তার জন্য সর্বতোভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”

আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো আদালতের ভাষা হবে সহজ, সরল, সাবলীল ও বোধগম্য। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল দেশের আদালত সহজ-সরল এবং সাধারণ জনগণের বোধগম্য মাতৃভাষায় রায় প্রদান করবেন, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি। কঠিন মাতৃভাষায় রায় লেখা যেখানে নিরুৎসাহিত করা হয়, সেখানে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় বা পরভাষায় রায় লেখা এক কথায় আইনের বিশ্বজনীন সুপ্রতিষ্ঠিত নীতির পরিপন্থী।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক 

চলবে…

আরও পড়ুন : মাতৃভাষায় আদালতের রায় : পর্ব-১