জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুই সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খান সংসদে যোগ দিতে চান। ৭ মার্চ শপথ নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে গতকাল শনিবার (২ মার্চ) জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। অবশ্য শপথ নেওয়ার ব্যাপারে এ দুই নেতা দলের অনুমতি পাননি।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, দল বা জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এ দুই নির্বাচিত সদস্য শপথ নিলে তাঁদের সদস্যপদ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কি না?
ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ দুই সাংসদের শপথ নেওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
আর গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফা মোহসীন মন্টু সম্প্রতি বলেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু হলে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুলতান মনসুরের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলে সদস্যপদ থাকবে কি থাকবে না, সে–সংক্রান্ত আইনি ফাঁক-ফোকরগুলো খুঁজে দেখা হয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, শপথ নিলে কোনো বাধা নেই। সাংসদ হিসেবে পুরো মেয়াদ তাঁরা থাকতে পারবেন।
ইতিমধ্যে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া অন্য দলগুলোর নির্বাচিত সাংসদেরা সাংসদ হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। গত ৩০ জানুয়ারি একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছে। সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচিত কোনো সদস্য সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক থেকে ৯০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ না করলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। এই হিসাবে সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে গণফোরাম বা তাদের দলের দুই সদস্যের সামনে এপ্রিল পর্যন্ত সময় রয়েছে। অবশ্য দুই সাংসদ তার আগেই শপথ নিচ্নমাধ্যসুলতান
মনসুর ও মোকাব্বির খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁরা ৭ মার্চ শপথ নেবেন। এ জন্য স্পিকারকে তাঁরা চিঠি দিয়েছেন।
গণফোরাম সূত্র জানায়, সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খানকে সংসদে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার পক্ষ থেকে এক ধরনের তৎপরতা আছে। বিশেষ করে রাজনীতির ময়দানে কোণঠাসা বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করার জন্য এই তৎপরতা চালানো হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দল রাজি না হলে দুই সাংসদ যাতে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে সেই তৎপরতাও আছে। যে কারণে এই দুই সাংসদ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে তাঁদের আইনি পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে সরকারি দল ও ঐক্যফ্রন্টের টেবিলে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে।
আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে কী ঘটবে? এ বিষয়ে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সাংসদ নির্বাচনের পর সাংসদ পদে থাকার অযোগ্য হবেন কি না, কিংবা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সাংসদের আসন শূন্য হবে কি না—এ সম্পর্কিত কোনো বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের নিকট পাঠানো হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তবে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।
এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান দল থেকে পদত্যাগ করেননি। সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার বিষয়টি তো আরও পরের কথা। তবে তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে এবং ওই অবস্থায় দল তাঁদের বহিষ্কার করলে পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।
গত ৩০ ডিসেম্বর গণফোরামের দুই সাংসদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। সুলতান মনসুর ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে এবং মোকাব্বির সিলেট-২ আসনে উদীয়মান সূর্য প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। এই নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র আটটি আসনে জয় পায়। নির্বাচিত আটজনের মধ্যে ছয়জন বিএনপির এবং দুজন গণফোরামের। ঐক্যফ্রন্ট এই নির্বাচনের এই ফল বর্জন করে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়।
এ ক্ষেত্রে অতীতের দুটি ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। নবম সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সাংসদ এইচ এম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তাঁর সদস্যপদ স্বতন্ত্র সাংসদ হিসেবে বহাল ছিল। তারও আগে অষ্টম সংসদের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। সে ক্ষেত্রেও তাঁর সদস্যপদ বহাল ছিল। দুটি ক্ষেত্রেই সংসদের ব্যাখ্যা ছিল, দল তাঁদের বহিষ্কার করেছে কিন্তু তাঁরা দল থেকে পদত্যাগ করেননি। যে কারণে তাঁদের সদস্যপদ বহাল ছিল।
দশম সংসদে সরকারদলীয় সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে পদত্যাগ করেন। এ কারণে তিনি সংসদ সদস্যপদ হারান।
আপাতত অপেক্ষা, দুই সাংসদ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাচ্ছেন কি না। আর যদি যান তবে বিতর্কটি নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে, নাকি বিতর্ক ছাড়াই তাঁরা সংসদে বসার সুযোগ পাবেন। প্রথম আলো