জাহালমের বিনা দোষে তিন বছর কারাভোগের দায় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নিতেই হবে বলে মন্তব্য করে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতিসংক্রান্ত ৩৩টি মামলার সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালত আগামী ১০ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন।
দুদকের মামলায় নিরীহ জাহালমের কারাভোগসংক্রান্ত মামলার শুনানি নিয়ে আজ বুধবার (৬ মার্চ) বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।
হাইকোর্ট বলেন, ‘ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় কতজন ব্যাংক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে? আমরা সব দেখব। দুদক যখন জানতে পারল জাহালম নির্দোষ, তখন তাঁর জামিন করানো উচিত ছিল। এর দায় দুদককে নিতেই হবে।’
এ মামলায় দুদকের পক্ষে হলফনামা জমা দেন আইনজীবী খুরশীদ আলম। তিনি শুনানিতে সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির মামলায় জাহালমকে কীভাবে ২৬ মামলার আসামি করা হয়, আবার দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালম কীভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হলেন—এসব ব্যাপারে হলফনামা থেকে আদালতকে পড়ে শোনান।
শুনানির একপর্যায়ে দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘দুদককে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সুপারিশের মধ্যে না থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুদক একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান। দুদক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা হোক, তা আমরা চাই না। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আগে দুর্নীতিবাজদের মানুষ ঘৃণা করত। আমাদের নৈতিক অধঃপতন হয়েছে।’
দুদকের এই আইনজীবী আদালতকে জানান, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিসংক্রান্ত মামলাগুলোর অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন বিচারিক আদালতে জমা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জাহালমের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ প্রত্যাহার চেয়েও বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়। খুরশীদ আলম হলফনামা থেকে তথ্য তুলে ধরে আদালতকে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সাক্ষীরা জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেন। তবে অধিকতর তদন্তে জানা যায়, প্রকৃত আসামি সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁও।
এ সময় আদালত খুরশীদ আলমের কাছে জানতে চান, ‘কবে আপনারা জানলেন জাহালম নির্দোষ আর কবে আদালতে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেন?’ তখন খুরশীদ আলম খান জানান, অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন তিনি আদালতে নিয়ে এসেছেন। এগুলো সবই তিনি আদালতে জমা দেবেন। আদালত তখন দুদকের এই আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘যখন আপনারা জানতে পারলেন জাহালম নির্দোষ, তখন আপনাদের উচিত ছিল জাহালমের জামিনের ব্যবস্থা করা। জাহালম বলে আসছেন, তিনি নির্দোষ। পিপিরা জানলেন কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর দায় আপনাদের নিতেই হবে।’
দুদকের আইনজীবী আদালতকে বলেন, জাহালমকে যে ২৬ মামলার আসামি করা হয়, সে–সংক্রান্ত সব কাগজপত্র তিনি আদালতে জমা দেবেন। আদালত তখন বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনার ৩৩টি মামলার সব কাগজপত্র আদালতে জমা দেবেন। আমরা সব দেখব।’
এ ব্যাপারে আদালত দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ১৮টি ব্যাংক। ১৮টি ব্যাংককে পার্টি করবেন। ১৮টি ব্যাংকের কাগজপত্র জমা দেবেন।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় কতজন ব্যাংক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন? আমরা তা দেখব। যাকে আসামি করা উচিত ছিল, তাকে সাক্ষী করেছেন। আদালত দুদকের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, কবে এসব কাগজপত্র জমা দেবেন?’ তখন খুরশীদ আলম খান চার সপ্তাহ সময় দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। আদালত আগামী ১০ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। একই সঙ্গে নিরীহ জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় সেদিন দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত), মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্রসচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন। আর সেদিন শুনানি নিয়ে জাহালমকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার ও আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।