আইন নিয়ে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে- ‘যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মতো, আর যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়সার জালের মতো!’ সে কারণেই হয়তো দেশের বিচার বিভাগের ঘাড়ে ৩৫ লাখের ওপর মামলার বোঝা। এর মধ্যে আবার বিচারক সংকট, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানামুখী সমস্যা।
সব মিলিয়ে দুর্ভোগের শেষ নেই সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের। বিচারের সুফল পেতে তাদের হতে হচ্ছে গলদঘর্ম। ভোগান্তির একপর্যায়ে আদালত বা বিচারব্যবস্থার ওপরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা। তবে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন ও সরকারের নানামুখী উদ্যোগে আশার আলো দেখাচ্ছেন বিচারসংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাসের অপেক্ষায় রয়েছে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প। আর এটি বাস্তবায়ন হলে গতি ফিরবে বিচার বিভাগে। অনেকটাই কমে যাবে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ। এ ছাড়া দেওয়ানি মামলায় চালু হয়েছে এডিআর (বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি) ব্যবস্থা। বিচারের বাইরে মধ্যস্থতার ভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তির এ ব্যবস্থা দিন দিন জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে। অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। বিনাখরচে গরিব-অসহায় মানুষের মামলা পরিচালনা ও ফি ছাড়া আইনি পরামর্শও দিচ্ছে সরকার। বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘবে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনও বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
ই-জুডিশিয়ারি
দক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তন, বিচারব্যবস্থার প্রশাসনিক এবং বিচারিক কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়, ই-আদালত কক্ষ প্রতিষ্ঠা, আইসিটি বিষয়ের জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে বিচারক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় ২ হাজার ২১০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের অনুমোদনও মিলেছে। এখন কেবল একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষা। প্রকল্পটির মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আইন, বিচার বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্টের ডেটা সেন্টার আপগ্রেডেশন এবং নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপন; ৬৪টি জেলায় মোট ১ হাজার ৪০০টি আদালত কক্ষকে ই-কোর্ট রুমে রূপান্তর এবং বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা; প্রতিটি জেলায় মাইক্রো ডাটা সেন্টার স্থাপন, আইন ও বিচার বিভাগ এবং সুপ্রিমকোর্টের কেন্দ্রীয় ডেটা সেন্টারের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ স্থাপন; বিচারকদের জন্য ২ হাজার ট্যাব বা ল্যাপটপ কম্পিউটার সরবরাহ; রেকর্ডরুম স্বয়ংক্রিয়করণ এবং পুরাতন রেকর্ডরুমগুলোকে ডিজিটাইজ করা; পূর্বের মামলার রেকর্ড ও সংশ্লিষ্ট রায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ; ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ ও ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং; বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম স্থাপন; বিচারব্যবস্থার কর্মকর্তাদের ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান, কেস ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা, বিচারব্যবস্থার জন্য এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার উন্নয়ন; এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সফটওয়্যার উন্নয়ন; বিচার বিভাগের সব অফিসের জন্য ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) স্থাপন।
মেগা এই প্রকল্পের ব্যাপারে সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারক (জেলা জজ) মঞ্জুরুল বাছিত গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি বাস্তবায়ন হলে বিচারকদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে। সার্বক্ষণিক তদারকিতে থাকবে সব কর্মকাণ্ড। গতি ফিরবে মামলা পরিচালনায়।’
মামলার বিভিন্ন ধাপের ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘ধরেন মামলা দায়েরের পরে সেটা ফাইলিং রেজিস্ট্রার ও জেনারেল রেজিস্ট্রারে ওঠাতে হয়। বিচারক ইচ্ছে করলেই এ রেজিস্ট্রার সব সময় দেখতে পারেন না, কিন্তু ই-জুডিশিয়ারি হয়ে গেলে সবকিছু কম্পিউটারাইজড হয়ে যাবে। মামলা ফাইল হলেই সার্ভারের মাধ্যমে কী ধরনের মামলা, কয়টা মামলা, কে বাদী, কে বিবাদী, মামলার বিষয়বস্তু কী- সব কিছু সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন তিনি। এক কথায় ‘আর্লি ম্যানেজারিয়াল ইন্টারভেনশন বাই দ্য কোর্ট’ এটা বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে মামলা গ্রহণযোগ্য কিনা, তা যাচাই-বাছাই করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। গ্রহণযোগ্য না হলে দায়েরের সঙ্গে সঙ্গেই তা খারিজ করে দিতে পারবেন। এভাবে বিভিন্ন ধাপে প্রতিনিয়ত মনিটর করতে পারবেন বিচারক। এ ছাড়া ই-জুডিশিয়রি হলে বিচারক ‘টেম্পল জাজমেন্ট’ অর্থাৎ একই বিষয়ে বা একই প্রকৃতির মামলার রায় কম্পিউটারে লেখা থাকলে তা অন্য কোনো মামলার রায়ের অংশ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। বিচারে একটি কষ্টকর কাজ সাক্ষীর সাক্ষ্য রেকর্ডিং করা, ই-জুডিশিয়ারি হলে এটা অটো রেকর্ডিং হয়ে যাবে। ভয়ঙ্কর দাগি আসামিকে কারাগারে রেখেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হবে। বিচারক একটু প্রো-অ্যাকটিভ হলেই ই-জুডিশিয়ারির মাধ্যমে তিনি অন্তত চারজনের সমান কাজ করতে পারবেন। এতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির পাশাপাশি দুর্ভোগও কমে আসবে।’
অবসরপ্রাপ্ত এই জেলা জজ আরও বলেন, ‘অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেভাবে সুপ্রিমকোর্টের হাতে নেই। বিচারকরা হয়তো মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করেন; কিন্তু প্রতিদিনের যে তদারকি সেটা হচ্ছে না। ই-জুডিশিয়ারি হলে হাইকোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জজ ঘরে বসেই অধস্তন আদালতের প্রতিটি কাজ মনিটর করতে পারবেন। এর ফলে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা বেড়ে যাবে। তখন আর কেউ কাজেও ফাঁকি দিতে পারবেন না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জনগণকে বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রীর যে অঙ্গীকার জনগণের কাছে দ্রুতবিচার পৌঁছে দেওয়ার, সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা আধুনিক, দুর্ভোগমুক্ত বিচার বিভাগের প্রত্যাশা করছি।’
এডিআর বাধ্যতামূলক
দেওয়ানি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে এডিআর কার্যকরে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এ বিধান অনুযায়ী, বিচারক মামলার আগে বা চলমান মামলায় এডিআর প্রয়োগ করতে পারবেন। তবে বিচার শুরুর আগে অবশ্যই বাদী-বিবাদীকে ডেকে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো দেওয়ানি মামলার আপিল পর্যায়েও এডিআর প্রয়োগ করতে পারবেন বিচারক।
এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এডিআর একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। এর মাধ্যমে একটি মামলা নিষ্পত্তি হলে তা থেকে নতুন মামলার উদ্ভব হয় না। কারণ সবাই উইন-উইন সিচুয়েশনে থাকেন। কিন্তু বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে ধাপে ধাপে আপিল হয় এবং মামলা চলে বংশপরম্পরায়। কানাডায় প্রায় ৯৯ ভাগ মামলা এডিআরের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হয়।’
অনলাইনে কার্যতালিকা
সুপ্রিমকোর্টে কাগজের পাশাপাশি অনলাইনেও প্রতিদিনের কার্যতালিকা প্রকাশ হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ওয়েব ঠিকানায় (http://www.supremecourt.gov.bd/web/) গেলেই সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের কার্যতালিকা, মামলার সংক্ষিপ্ত ফলাফল, সর্বশেষ অবস্থা, রায় ও আদেশ অনুলিপি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার কয়েকটি আদালতসহ দেশের বেশ কিছু আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকাও পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। সারাদেশে এ কার্যক্রম চালু হলে বিচারপ্রার্থীরা ঘরে বসেই তার মামলার খোঁজখবর নিতে পারবেন।
জামিন আদেশও অনলাইনে
উচ্চ আদালতে কোনো আসামির জামিন হয়েছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য আগে বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় টেলিফোনে যোগাযোগ করা হতো। ফলে ভোগান্তির শিকার হতেন বিচারপ্রার্থীরা, আবার জালিয়াতির ঘটনাও ঘটত। কিন্তু এখন অনলাইনেই জামিন আদেশ যাচাই করা হয়। হাইকোর্টের আদেশের অনুলিপি আপলোড করা হয় নির্দিষ্ট অনলাইন সফটওয়্যারে। অনুমোদিত ব্যক্তিরা নিজের ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে জামিন আদেশ যাচাই করে নিতে পারেন।
বিচার বিভাগে ডিজিটাইজেশনের এসব পদক্ষেপ ছাড়াও অনলইনে বিচারকদের ছুটির আবেদন ও মঞ্জুরসহ ছোটখাটো আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিচার বিভাগকে পুরোপুরি ডিজিটালাজ করা হলেই কেবল বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমে আসবে। এসব উদ্যোগের ধারাবাহিতা বজায় রাখার পাশাপাশি বেশি সংখ্যক বিচারক নিয়োগও জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের। সূত্র : আমাদের সময়