হাইকোর্ট ২০১৮ সালে দেশের হিমাগারগুলোতে ৫০ কেজির অধিক ওজনের আলুর বস্তা সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু আদালতের এ আদেশ অমান্য করেই দিনাজপুরের অধিকাংশ হিমাগারগুলোতে রাখা হচ্ছে ৫০ কেজির অধিক ওজনের আলুর বস্তা। এতে হিমাগারমালিকেরা লাভবান হলেও বেশি ওজনের বস্তা বহন করতে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন শ্রমিকেরা। এমনকি বেশি ওজনের বস্তা বহনের জন্য প্রাপ্য মজুরিও পাচ্ছেন না তাঁরা।
দিনাজপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দিনাজপুরে ১২টি হিমাগার রয়েছে। এগুলোতে কর্মরত দেড় সহস্রাধিক শ্রমিক। আদালতের আদেশ মানা হচ্ছে কি না, তা জানতে গত শনিবার আটটি হিমাগার ঘুরে দেখা গেছে, এগুলোর প্রধান ফটকে ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা ‘উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ৫০ কেজি ওজনের অধিক বস্তা গ্রহণ করা হয় না।’ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এগুলোর টিনশেড থেকে আলুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ (পিসি) এলাকা, পিসি এলাকা থেকে আলু রাখার স্থানে (চেম্বার) থরে থরে সাজানো আলুর বস্তা। প্রতিটি হিমাগারে ১০-১২টি আলুর বস্তা ওজন স্কেলে পরিমাপ করে দেখা যায়, সেগুলোর ওজন ৭৫-১০০ কেজি।
ওই আটটি হিমাগারের মধ্যে একটি দিনাজপুর শহরের সুইহারী খালপাড়া এলাকায় পুনর্ভবা ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজার্ভস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, হাইকোর্টের আদেশের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল। বিষয়টি নিয়ে দিনাজপুর বণিক সমিতির জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। সেখানে জেলা প্রশাসন চলতি বছরের জন্য ৩০ শতাংশ আলুর বস্তা ৫০ কেজির ওপরে রাখতে পারবে বলে অলিখিত নির্দেশনা দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর দিনাজপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘সুস্থ শ্রমিক নিরাপদ জীবন, নিশ্চিত করে টেকসই উন্নয়ন’ কিংবা ‘শ্রম আইন মেনে চলি ৫০ কেজির অধিক ওজনের বস্তা বহন বর্জন করি’। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যহানির বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এই স্লোগান রচনা করে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬–এর ৭৪ ধারা এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫–এর ৬৩ বিধিতে শ্রমিকদের ৫০ কেজির অধিক ওজন বহন করা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। কিন্তু এরপরও ৫০ কেজির অধিক ওজন বহনে বাধ্য করা হয় শ্রমিকদের। এর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে রাজশাহী জেলার পবা উপজেলা লোড–আনলোড কুলি শ্রমিক ইউনিয়ন নামের একটি শ্রমিক সংগঠন। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। পরে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর হাইকোর্টের ওই আদেশ দেশের সব হিমাগারগুলোতে নোটিশ দিয়ে জানায়।
অধিক ওজনের বস্তা ওঠানো–নামানোয় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে দিনাজপুর জেলা সিভিল সার্জন আবদুল কুদ্দুস বলেন, অধিক ওজন বহন করার ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের হাড় বেঁকে যাওয়া, স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে যাওয়া, কোমরের হাড় ক্ষয়, অকালে স্বাস্থ্যহানি, কর্মক্ষমতা হ্রাসসহ স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করার আশঙ্কা থাকে।
দিনাজপুরের দশমাইল এলাকায় রাহবার হিমাগার প্রাইভেট লিমিটেডের শ্রমিক পঙ্কেশ বাবু (৪৫) বলেন, ‘বাইরে কাজ নাই, পেটের দায়ে বস্তা টানেছি। বড় বড় বস্তা ওঠানো–নামানো খুবই কষ্টের কাজ। যে কাজ করি দিন শেষে শরীর চলে না ভাই।’ একই হিমাগারের শ্রমিক হবিবর রহমান বলেন, ‘মহাজন কইছিল এবার বস্তা ছোট হইবে। কিন্তু আগের মতোই বস্তাগিলা বড়। তিন বছর থাকি ছোট বস্তা করার জন্য কহি আসোছি ভাই, মহাজন শুনে না। উল্টো কাজ না করিলে চুক্তির ভয় দেখায়া জেলের কথা কহওছে।’
পুনর্ভবা ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজার্ভস লিমিটেডের শ্রমিক শাহীনুর আলমের কথায়ও উঠে এল বেশি ওজনের আলুর বস্তা টানার কথা। তিনি বলেন, ‘নীলফামারী থাকি হামরা ৪০ জন আসিছিলাম। বস্তার ওজন দেখিয়া ভয়তে ১২ জন বাড়ি চলি গেইছে। প্রায় ১৫০ জনের মতো লেবার আছি এখানে। তাঁদের মধ্যে গাড়ি থেকে শেড পর্যন্ত যাঁরা বস্তা নামায় তাঁরা বস্তাপ্রতি ৫ টাকা, শেড থেকে পিসি পর্যন্ত যাঁরা বস্তা টানে তাঁরা ৪ টাকা। আর যাঁরা পিসি থেকে চেম্বারে বস্তা নিয়ে যান, তাঁরা পান ৮ টাকা। শ্রমিকদের দাবি, বস্তাপ্রতি প্রতিটি স্তরে অন্তত ২ টাকা বাড়ানো হোক।’
বাজারে ৫০ কেজি ওজনের বস্তা পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ না থাকার কথা উল্লেখ করে বখতিয়ার বলেন, ‘যেসব জুট মিলে বস্তা তৈরি হয় সেখানে যদি ২৩–৩৮ সাইজের বস্তা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে হাইকোর্টের আদেশ শতভাগ মেনে চলা সম্ভব হবে।’
হিমাগারগুলোর হাইকোর্টের আদেশ মান্য না করার কথা স্বীকার করেছেন দিনাজপুর জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী হিমাগারগুলো পরিদর্শন করেছি। হিমাগার কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মাসিক সমন্বয় সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে।’ শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম বলেছেন, হিমাগারে ৫০ কেজি ওজনের অধিক আলুর বস্তা রাখার বিষয়টি নজরে এসেছে। শিগগিরই এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সূত্র : প্রথম আলো