রাজীব কুমার দেব :
ইদ্দত একটি ধর্মীয় বিধান। পবিত্র কোরআনের সুরা তালাকে ইদ্দত সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরানে উল্লেখ আছে “And the divorced woman should keep themselves in waiting for three courses (II-228 and ” And those of your woman who despair of menstruation, if you have a doubt, their prescribed time is three months, and of those too, who have not had their courses” (XXXVIII4).
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে ইদ্দত সময়কাল শুরু হয় দুই ক্ষেত্রে – তালাক এবং স্বামীর মৃত্যু। ২য় ক্ষেত্রে ইদ্দত সময়কাল শুরু নিয়ে কোন মতানৈক্য নেই। তবে তালাকের ক্ষেত্রে ইদ্দত সময়কাল নিয়ে মতবিরোধ লক্ষ্যনীয়।
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রত্যেক স্কুলে তালাকের ক্ষেত্রে ইদ্দত recognized কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ইদ্দত শুরুর সময়কাল বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। অর্থাৎ ইদ্দত সময়কাল তালাক ঘোষণার দিন নাকি কার্যকর হওয়ার দিন থেকে শুরু হবে – এ ধরণের সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে পবিত্র কোরান, custom, usage এ ইদ্দত ‘course” বা “সময়” উল্লেখ আছে।
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে ৮ ধরণের তালাকের কথা বলা আছে। আরো বলা আছে যে সর্বশেষ ঘোষণার সাথে সাথেই ইদ্দত সময় কাল শুরু হবে এবং এই ইদ্দত সময়কালে যদি স্ত্রীর সাথে cohabitation না হয় তাহলে তালাক Irrevocable” হবে। অর্থাৎ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে তালাকে চূড়ান্ত ঘোষণার তারিখ থেকে ইদ্দত সময়কাল শুরু হয় এবং ইদ্দত সময়কালের বা ৯০ দিন শেষে তালাক কার্যকর হয়। উল্লেখ্য limited practice এ তখনকার সময়ে লিখিত “তালাক নামা” প্রদানের মাধ্যমে “তালাক আল বিদ্যাত” প্রদানের রীতি প্রচলিত ছিল তবে “তালাক নামা” প্রদানের তারিখ থেকে ইদ্দত সময়কাল শুরু হত। এই প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত মামলা উল্লেখ করা যেতে পারে – Rashid Ahmed vs Anisa Khatoon (1932) 59 IA 21 (Alld): 1932 PC 25.
তবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ ধারা অনুসারে আবশ্যিকভাবে নোটিশ প্রদানের বিধান চালুর মাধ্যমে কার্যত ৮ ধরনের তালাক ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রকারান্তরে ১ রকমের তালাক ব্যবস্থা প্রচলন শুরু হয়েছে। আর এই অধ্যাদেশের ৩(১) ধারা মতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সকল custom or usage এর উপর overriding effect দেয়া হয়।
তবে এই আইনে ইদ্দত কিংবা ইদ্দত কালীন সময় কখন শুরু হবে সেই সম্পর্কে বলা হয় নাই। কিন্তু ৭ ধারায় উপধারা ৩ ও ৪ এ ৯০ দিন অথবা গর্ভকালীন সময় উল্লেখ করা আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ৯০ দিন বা গর্ভকালীন সময় কাল ইদ্দত সময়কালকে indicate করে কিনা?
যেহেতু এই অধ্যাদেশের ৩(১) ধারা মতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সকল custom or usage এর উপর overriding effect থাকলেও ইদ্দত কালের উপর প্রযোজ্য নয় এবং যেহেতু ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বাধ্যতামূলক ভাবেই একটি সময়ের বিধান করেছে এবং যেহেতু এই সময়ে reconciliation এর মাধ্যমে তালাক revocable এর সুযোগ আছে এবং যেহেতু এই সময় শেষ হলেই automatic তালাক কার্যকর হবে সেহেতু এই ৯০ দিনের reconciliation সময় কে ইদ্দত সময়কাল হিসেবে ধরে নিতে হবে এবং ৭ ধারায় নোটিশ দেওয়ার সাথে সাথেই ইদ্দত সময়কাল শুরু হবে।
এখন “কার্যকর সময়” এর পক্ষে মতামত প্রদানকারী বিজ্ঞজনদের প্রতি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রশ্ন – ১। যদি তালাক কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইদ্দত সময়কাল শুরু হয় তাহলে এই সময় কালে যদি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ও স্বামী যদি cohabit করে তাহলে তালাক কার্যকর হওয়ার পর তালাক কি ‘revoked” বলে গণ্য হওয়ার সুযোগ আছে? উল্লেখ্য মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে কিন্তু ইদ্দত সময়কালে cohabit হলেই তালাক revoked মর্মে গণ্য হওয়ার বিধান আছে। এক্ষেত্রে principle of overriding effect প্রযোজ্য নয়। ২। ইদ্দত সময়কাল যদি কার্যকর হওয়ার পর থেকে শুরু হয় তাহলে অধ্যাদেশের ৭(৩) ধারায় বর্ণিত ৯০ দিনের সময়ের কোরানিক বা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ভিত্তি কি? সেই ক্ষেত্রে reconciliation period ৯০ দিন এবং ইদ্দত কালীন সময় ৯০ দিন মোট ১৮০ দিন এবং এই ১৮০ দিন সময়ের কোরানিক বা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে ভিত্তি কোথায়?
ইদ্দত সময়কালে স্বামীর উপর স্ত্রীর ভরণপোষণ ওয়াজিব করা হয়েছে। ইদ্দতকালীন স্ত্রীকে স্বামীর সংসার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া জুলুম ও হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইদ্দতকালীন স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ বসতে পারে না। কারণ তখন পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয়নি। তালাকদাতা স্বামী ইচ্ছা করলে তালাক প্রত্যাহার করে বিবাহ বলবৎ রাখতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইদ্দতের মেয়াদ কত? এক। মৃত্যুর ক্ষেত্রে- চার মাস দশ দিন। দুই। যার হায়েয নাই (বয়সের স্বল্পতা কিংবা বার্ধক্যের কারণে)- তিন মাস। তিন। যার হায়েয আছে- তিন হায়েয (হানাফি মতে)/ তিন তোহর (শাফেয়ী মতে)। চার। স্ত্রী গর্ভবতী হলে- সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত। সুতরাং তালাক কার্যকর হবার পরে ইদ্দতের আবশ্যকতা কোথায়? তালাক প্রদানের পরেই ইদ্দত সময় গণনা শুরু হয়।
লেখক : জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, কক্সবাজার।