“শিশু জিহাদের মামলায় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাংবিধানিক আইনে ক্ষতিপূরণের দ্বার উন্মোচিত হয়। চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (সিসিবি) বনাম সরকারের এই মামলায় শিশু জিহাদের বিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের রায়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হল সাংবিধানিক আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য।”
আজকে দ্বিতীয় তথা শেষ পর্বে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহামুদ আজিমের নেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এইভাবেই আলোচনা শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : ‘চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে আপনার একটি সংগঠন রয়েছে, এর কাজ কি?
ব্যারিস্টার হালিম : শিশুদের মেধা বিকাশে কাজ করার লক্ষ্যে আমি ২০০৪ সালে “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন”( সিসিবি) নামক একটি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করি এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক কাজের সূচনা হয় আমার নিজ এলাকা থেকে। “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন”( সিসিবি) পক্ষ থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে বাংলা ও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের উপর চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে থাকি। উক্ত পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মাসিক হারে, এককালীন ও যারা খুবই দরিদ্র তাদের মেধাকে ধরে রাখতে আমার “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন” দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ দিয়ে থাকে। এমন অনেকগুলো ক্যাটাগরিতে “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন” বৃত্তি প্রদান করে থাকে। “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন” জন্য আমার নিজের আয়ের থেকেও একটা অংশ জমা রাখি। এই “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন” এর সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেকের মত শিক্ষার্থী তাদের পড়াশুনা সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে অনেকে এই ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি এই ফাউন্ডেশানে দুইদিক দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে থাকি। প্রথমত, আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষামুখি করা এবং দ্বিতীয়ত, আমি পেশায় আইনজীবী হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে শিশুদের অধিকার আদায়ের জন্য জনস্বার্থের মামলা করে সেটা নিজ উদ্যোগে পরিচালনার চেষ্টা করে শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণে কাজ করে থাকি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার উল্লেখযোগ্য একটি মামলা শিশু জিহাদের মৃত্যু মামলা, মামলাটি কেন করলেন এবং এর ফলাফল সম্পর্কে যদি একটু বলতেন…
ব্যারিস্টার হালিম : শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে পাইপের মধ্যে আটকা পড়ে শিশু জিহাদ মারা গিয়েছিলো। ফায়ার সার্ভিসের লোক সারারাত চেষ্টা করেও তাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে তারা জানায় এখানে মানব শিশুর কোন অস্তিত্ব নেই বরং টিকটিকি তেলাপোকায় পাইপটি ভরাট হয়ে রয়েছে। অথচ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা পাইপটাকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে চলে যাবার ঠিক দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে দেশীয় পদ্ধতির একটা খাঁচা তৈরি করে স্থানীয় ছয়জন যুবকের সহযোগিতায় শিশু জিহাদের মৃতদেহ উপরে তুলে আনা হয়। অন্যদিকে শিশু জিহাদ পাইপে আটকা পড়েছে এমন মিথ্যে অভিযোগ পুলিশকে দেওয়ায় পুলিশ জিহাদের বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করার মতো হীন কর্মকাণ্ডও প্রতীয়মান হয়। অথচ যেখানে পরবর্তীতে জিহাদের মৃত্যুর ঘটনা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। যা টেলিভিশনে সারাদেশে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। সাধারণ একটা পাইপের ভিতর থেকে একটা মানব শিশু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো এমন একটি ঘটনাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় রাষ্ট্র চরমভাবে সবদিক থেকে ব্যর্থ। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশু জিহাদের জীবনটাকে ধ্বংস করে দিতে হল রাষ্ট্র, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতার কারনে। এর প্রতিকার দিতে রাষ্ট্র অবশ্যই বাধ্য। অপর দিকে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এবং সেটার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা প্রতীয়মান হলে সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারে। সাংবিধানিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘিত হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে বিধান সেটা উন্নত দেশে অনেক পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত। আর আমাদের পাশের দেশ ভারতে এটা ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিশু জিহাদের মামলায় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাংবিধানিক আইনে ক্ষতিপূরণের দ্বার উন্মোচিত হয়। “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন”( সিসিবি) বনাম সরকারের এই মামলায় শিশু জিহাদের বিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের যে রায় প্রকাশ পেলো এই রায়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হল যে সাংবিধানিক আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। এর মাধ্যমে আরেকটা বিষয় স্পষ্ট হল সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো যেন তাদের দায়িত্বে অবহেলা না করে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সর্বদা সজাগ থাকে তার জন্য এই সাংবিধানিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা। যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ এ সুরক্ষিত রয়েছে। এই সুরক্ষা রক্ষার প্রথম বহিঃপ্রকাশ দেখি এই শিশু জিহাদের মামলায়। যে মামলা “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন”( সিসিবি) দায়ের করে। এই মামলার ন্যায্য বিচারের জন্য আমরা সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে জয় ছিনিয়ে আনি এবং শিশু জিহাদের বাবা-মাকে রেলওয়ে এবং ফায়ার সার্ভিস ১০ লক্ষ করে মোট ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে “চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন”( সিসিবি) বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর সাথে যুক্ত হয়ে মামলার কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করছে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার লেখা আইন বিষয়ক বেশ কিছু বই আইনাঙ্গনে ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে, কবে থেকে লেখালেখি শুরু করলেন এবং এই বিষয়ে লিখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কেন?
ব্যারিস্টার হালিম : ছাত্রজীবন থেকেই আমার লেখালেখির শুরু। অনেক চেষ্টা করেও যখন অনার্সে কোন অবস্থায় ফার্স্ট ক্লাস পাচ্ছিনা, তখন আমার মাঝে একটা জেদ কাজ করে। পরীক্ষায় ভালো করতে পারছি না কিন্তু অন্যভাবে আমি আমার মেধাকে প্রকাশ করে দেখাবো। আইন বিষয়ে পড়াশুনা করায় সময়ে দেখলাম আইন বিষয়ে বাজারে বইয়ের সাংঘাতিক অপ্রতুলতা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে বাজারে মানসম্পন্ন বই ছিলনা বললেই চলে। সে সময় একমাত্র অর্থবহ বই ছিলও গাজী শামসুল রহমানের বই। কিন্তু বইগুলো সাধু ভাষায় রচিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বুঝতে অসুবিধা হতো। তাই যেহেতু অনার্সে আমার ভালো ফলাফল হচ্ছে না তাই আমি অনার্সে থেকেই সাংবিধানিক আইনের উপর একটি বই লিখি। ড. এরশাদুল বারী তখন আমাদের শিক্ষক ছিলেন। তার দেওয়া লেকচারগুলো আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে বই লিখার ক্ষেত্রে। “সংবিধান, সংবিধানিক আইন ও রাজনীতি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ” নামক ছোট আকারে বইটি আমি প্রকাশ করি যখন আমি সম্মান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আমার প্রথম প্রকাশিত বইটির ভূমিকা লিখে দেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন ড. এরশাদুল বারী স্যার। পরবর্তীতে আমি যখন মাস্টার্সে পড়ি তখন বইটার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করি। ঐ বইটার একটা কপি আমি তখন ব্রিটিশ হাই কমিশনে পাঠিয়ে দি। তখনকার ব্রিটিশ হাই কমিশনার ছিলেন ডেবিট সি ওয়াকার। মিঃ ডেবিট সি ওয়াকার বইটি পড়ে একটি রিভিউ লিখেন। ঐ রিভিউটা ডেইলি স্টারে বুক রিভিউতে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বইটার একাদশতম সংস্করণ বাজারে চলছে। বাংলা ও ইংরেজি দুইটা ভার্সনই বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : এ যাবত কালে আপনার কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে, উল্লেখযোগ্য কোন বই রয়েছে? থাকলে সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
ব্যারিস্টার হালিম : এই পর্যন্ত আমার ৬২ টা বই প্রকাশিত হয়। লন্ডন থেকে পড়াশুনা সম্পন্ন করে ফিরে আসার পর আইন পেশার পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখিটা চলমান রাখি। নবীন আইনজীবীদের কথা বিবেচনা করে ক্রিমিনাল ও সিভিল সাইট নিয়ে দুই ভলিয়মের একটি বই প্রকাশ করি “প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউর ইন দ্যা সুপ্রিম কোর্ট” এর মাধ্যমে নবীন আইনজীবী যাদের জজ কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করতে এসে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায় তাদের উপকারে আসবে। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর আদালতে প্র্যাকটিসের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। সেক্ষেত্রে বইটি তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও আমার আইন বিষয়ে একাধিক বই আইনাঙ্গনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার লেখা বই আইন শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়, আইন শিক্ষায় ভালো করতে আপনার পরামর্শ কি?
ব্যারিস্টার হালিম : আমাদের দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইন শিক্ষার সাথে যে প্রায়োগিক দিকটা রয়েছে সেটি প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা, আমরা এখনো সেই পুরনো কিংবা আদি যুগের সিলেবাস অনুসরণ করে যাচ্ছি। অথচ যেখানে উন্নত বিশ্ব সমস্যা থেকেই সমাধান খুঁজে বের করার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেছে তাদের সিলেবাসে। এতে করে শিক্ষার্থীরা বইয়ের পড়াশুনার পাশাপাশি আইনের প্রায়োগিক দিক সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পেয়ে থাকে। তাই আমি মনে করি আমাদের বর্তমান আইনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আপডেট করা উচিত। তাতে করে আইন শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা সম্পন্ন করে এই পেশায় আরও ভালো করবে বলে আমার বিশ্বাস।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে আইনজীবীদের দায়বদ্ধতা কতটুকু এবং এই ক্ষেত্রে আইনজীবীরা কতটা আন্তরিক বলে আপনি মনে করেন?
ব্যারিস্টার হালিম : আইনজীবীরা হচ্ছেন সমাজের পরিবর্তন আনার মূল কর্ণধার। শেরে বাংলা, গান্ধী কিংবা নেহেরুর মতো সমাজ প্রবর্তকরা সবাই ছিলেন ব্যারিস্টার কিংবা আইন অঙ্গনের সাথে জড়িত। তাই আইনজীবীদের সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা সীমাহীন। আব্রাহাম লিংকনও একজন আইনজীবী ছিলেন। পৃথিবীতে বড় বড় বিপ্লব হয়েছে যাদের মাধ্যমে তারা সবাই আইন পেশা থেকেই এসেছেন। সুতরাং সাধারণ মানুষের আইনজীবীদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বড়। আইনজীবীদের বিপ্লবী ধারণা থেকে অনায়াসেই সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন- মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই করে তাদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। এছাড়া, জনস্বার্থে মামলাগুলোও সমাজে বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে সহায়ক হতে পারে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার ব্যস্ততম সময় থেকে আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ব্যারিস্টার হালিম : ল’ইয়ার্স ক্লাব আমাদের আইনজীবীদের সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করে তাই আমি ল’ইয়ার্স ক্লাবে সাক্ষাৎকার দিতে পেরে গর্ববোধ করছি সে সাথে ল’ইয়ার্স ক্লাবের জন্য রইলো অসংখ্য শুভ কামনা।